ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভাল, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ।-জন লক
প্রসঙ্গ কথা
২০১৮ সালে বিবিসি বাংলা জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল সেখানে বলা হয় বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বের ১২৯ টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে। রিপোর্টটি শুক্রবার প্রকাশ করা হয়েছে।
রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।
একশো উনত্রিশটি দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে যে সূচক এই সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০ নম্বরে। একই অবস্থানে আছে রাশিয়া।
উরুগুয়ে, এস্তোনিয়া এবং তাইওয়ান আছে এই সূচকের শীর্ষে। আর একেবারে তলায় রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়া।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান অবশ্য বাংলাদেশের নীচে – ৯৮ নম্বরে। মিয়ানমারের অবস্থান ১০৪ নম্বরে। অন্যদিকে ভারত আছে বেশ উপরের দিকে – ২৪ নম্বরে। শ্রীলংকার অবস্থান ৪১ নম্বরে।
‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে এ ধরণের রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে।
তবে তাদের এই সমীক্ষায় উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ পরিণত গণতন্ত্রের দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, “বিশ্বে গত ১২ বছরের মধ্যে গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এক সময় বিশ্বের যেসব দেশকে মুক্ত বলে ভাবা হতো, সেসব দেশের সরকারও ক্রমশ কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠছে।”
রিপোর্টে বলা হয়, “বিশ্বে যে স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা সামান্য বেড়েছে, সেটার চাইতে বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে গণতান্ত্রিক দেশুগুলিতেও এখন নাগরিক অধিকার ক্রমশ খর্ব করা হচ্ছে এবং আইনের শাসন ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। ব্রাজিল, পোল্যান্ড এবং তুরস্কের মতো দেশ, যাদেরকে গণতন্ত্রায়নের আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, তাদেরই সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটেছে।”
এই রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তুরস্কের কথা। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে তাদের সর্বশেষ রিপোর্টের পর তুরস্কেই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বেশি অধোগতি দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান সেখানে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর মত প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করেছেন বলে মন্তব্য করা হয়।
‘বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক নয়’
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই সমীক্ষা চালানো হয় যেসব দেশের ওপর, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি দেশের কথা—বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এই পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে।
“এই পাঁচটি নতুন স্বৈরতান্ত্রিক দেশ এমন একটা পর্যায় অতিক্রম করেছে, যেদিকে যাচ্ছে আরও কিছু ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশ – হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, মলডোভা, নিজার, ফিলিপাইন এবং তুরস্ক।”
তবে রিপোর্টে কিছু কিছু দেশে গণতান্ত্রিক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, মরিশাস এবং উরুগুয়ে।
২০১৬ সালের রিপোর্টে বার্কিনা ফাসো এবং শ্রীলংকাকে মধ্যম মাত্রার স্বৈরতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এই দুটি দেশকে এবারের রিপোর্টে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ছিল:
বেরটেলসম্যান স্টিফটুং এর এই রিপোর্টটির ব্যাপারে বিবিসি বাংলা কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে। বিবিসি বাংলার পরিক্রমা অনুষ্ঠানে মাসুদ হাসান খানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন।”
রিপোর্টটির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “যে সমীক্ষার ভিত্তিতে রিপোর্টটি করা হয়েছে, সেটির তথ্য তারা কোথায় পেয়েছে? রিপোর্টটি যদি ২০১৫ সাল থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হয়ে থাকে, তাহলে সেবছর তো বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটছিল। বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপি যে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছিল, তখন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ চরমভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছিলেন, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হচ্ছিল,আহত করা হচ্ছিল। “
এইচ টি ইমাম বলেন, বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র বা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, তাদের কারও কাছে কখনো তিনি এরকম কোন সমীক্ষা হচ্ছে বলে শোনেন নি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত রক্ষা করা হচ্ছে না বলে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, “গণতন্ত্রের মানদন্ড কি আমাদের জার্মানদের কাছ থেকে শিখতে হবে? হিটলারের দেশ থেকে?”
২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেসব পরবর্তীকালে বিশ্বের সব দেশ মেনে নিয়েছে বলে দাবি করেন এইচ টি ইমাম। তিনি বলেন, ‘ঐ নির্বাচন সঠিকভাবে হয়েছে, সবাই অংশ নিয়েছে। ঐ নির্বাচনের পরে যদি এই সমীক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে অন্য কারণ আছে।”
বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে রিপোর্টে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তার জবাবে এইচ টি ইমাম বলেছিলেন, ” বাংলাদেশে এখন ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয় প্রায় তিনশোর বেশি দৈনিক। প্রত্যেকটি সংবাদপত্র কিভাবে লিখছে আপনারা দেখতে পারেন। প্রত্যেকটি টেলিভিশনের টক শো যদি আপনি দেখেন, সেখানে কি মত প্রকাশের অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই? বাংলাদেশে মোটেই কোন কিছু সেন্সর করা হচ্ছে না।”
গণতন্ত্র সূচকে এক ধাপ এগিয়ে ৭৫তম বাংলাদেশ ২০২১ সালে
গণতন্ত্র সূচকে এক ধাপ এগিয়ে ৭৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এ সূচক প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
১৬৫টি দেশ ও ২টি অঞ্চল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ২০২১ সালের এই সূচক। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৯৯। আগের বছরেও একই স্কোর নিয়ে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭৬তম। এর আগের বছর ছিল ৮০তম। এ হিসেবে সূচকে ধারাবাহিক উন্নতির পথে রয়েছে বাংলাদেশ।
সূচকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ৪৬ ও ১০৪।
গত কয়েকবারের মতো এবারও ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা’ বিভাগেই রয়েছে বাংলাদেশ। ১০–এর মধ্যে যেসব দেশের স্কোর ৪ থেকে ৬–এর মধ্যে, তারাই রয়েছে এ বিভাগে। ২০২১ সালের সূচকে এ বিভাগে রয়েছে ৩৪টি দেশ।
হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা বলতে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। এ শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দল ও বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের নিয়মিত চাপ থাকে।
ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ও দুর্বল আইনের শাসন, দুর্বল নাগরিক সমাজ হাইব্রিড ধরনের শাসব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এ বিভাগে থাকা দেশগুলোতে বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিকদের হয়রানি ও চাপ দেওয়া হয় বলে ধরে নেওয়া হয়।
এবারের সূচকে শীর্ষ স্থানে আছে নরওয়ে। দেশটির স্কোর ৯ দশমিক ৭৫। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড। সুইডেন ও আইসল্যান্ড আছে চতুর্থ ও পঞ্চমে।
অপর দিকে তালিকায় সবচেয়ে পেছনে রয়েছে আফগানিস্তান (১৬৭তম)। দেশটির স্কোর শূন্য দশমিক ৩২। দেশটির আগে রয়েছে মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র।-১১ ফেব্রুয়ারী ২০২২ প্রথমআলো পত্রিকায় প্রকাশিত
প্রসঙ্গ কথা : এক সময় স্বৈরতান্ত্রিক দেশ ছিল জার্মানি অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন জার্মানির সর্বকালের সেরা স্বৈরশাসক। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় নতুন করে অ্যাডলফ হিটলার স্বৈরতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমানে নানা দেশ নানা ভাবে স্বৈরতন্ত্রের শিকলে আবদ্ধ করে দুনিয়াকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে নব্য স্বৈরশাসকরা। কেউ ঘোষিত স্বৈরশাসক আবার কেউ বা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরশাসক। স্বৈরশাসকদের শাসনে মানবতার অপমৃত্যু ঘটে। আমরা দেখেছি মুক্তিকামী মানুষকে ফুঁসে উঠতে। শুরু হয় শাসক ও শোষিতের লড়াই। কোথাও সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসক কোথাও বা তথাকথিত নির্বাচিত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। যার শেষ পরিণতি হয় থাকে ভয়াবহ ইতহাস তাই বলে।এ কথা সত্য যে, ইতিহাস শুধু বিখ্যাত মানুষদেরই মনে রাখে না, সেই সাথে কুখ্যাত মানুষদেরও মনে রাখে।