বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন
আলাপচারিতার সকল পাঠক দর্শক শ্রোতা সকলকে ইংরেজি নতুন বছরের আন্তরিক শুভেচ্ছা
বাংলাদেশে তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে। হিজরি, ইংরেজি ও বাংলা। বছর ঘুরে আবার আমাদের দ্বারপ্রান্তে ইংরেজি নতুন বছর ২০২৩।
৩১ ডিসেম্বর দিন পেরিয়ে শুণ্য ঘণ্টা থেকে শুরু হয় উৎসব। রাতের এ উৎসবকে বলা হয় ‘ থার্টি ফার্স্ট নাইট ‘।রীতি অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখে বাংলাদেশে নিউ ইয়ার উদযাপন করা হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের তেমন প্রচলন নেই। গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও এ উৎসব উদযাপন হলেও তা খুবই নগণ্য। কিন্তু বড় শহর ও মফস্বলে এ উৎসবের জনপ্রিয়তা বেশ লক্ষণীয়।
নববর্ষ বা নতুন বছর হল সেই সময় বা দিন যখন থেকে একটি নতুন পঞ্জিকার বছর শুরু হয় এবং পঞ্জিকার বছরের গণনা এক এক করে বৃদ্ধি হয়।অনেক জাতিই বেশকিছু সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি উদ্যাপন করে এবং জানুয়ারীর প্রথম দিনটি প্রায়শই জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত বর্ষপঞ্জি হল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, আর তাতে নতুন বছর শুরু হয় জানুয়ারির ১ তারিখে (নতুন বছরের দিন)। রোমান বর্ষপঞ্জি (কমপক্ষে ৭১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) এবং জুলীয় বর্ষপঞ্জি উভয় ক্ষেত্রে এটি একই ছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য ভিন্ন বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়েছে; কিছু বর্ষপঞ্জির সংখ্যা গণনা করা হয়, আবার কিছুর গণনা করা হয় না।মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলিতে যখন জুলীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করা হত, বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়র উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ গণনা করা হত; যেমন ১ মার্চ, ২৫ মার্চ, ১ সেপ্টেম্বর, ২৫ ডিসেম্বর। ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী চালু করা হয় এবং পুরাতন পদ্ধিতি ও নতুন পদ্ধতির তারিখগুলোতে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয় যার ফলে নতুন বছরের জন্য বিভিন্ন স্থানীয় তারিখের বদলে একটি নির্দিষ্ট তারিখ (১ জানুয়ারি) প্রবর্তিত হয়।
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের সূচনা যে ভাবে
বিশ্বব্যাপী পালিত উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হিসেবে মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় (যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সে সময়কার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে) প্রথম বর্ষবরণ উৎসব পালনের প্রমান পাওয়া যায়। বর্তমান ইরাকের প্রাচীন নাম ছিল মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টি পর্যায়ে ববিভক্ত ছিল। সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসেরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁক জমকের সঙ্গেই পালন করা হতো বর্ষবরণ উৎসব। তবে তা এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না বরং তা পালিত হতো বসন্তের প্রথম দিনে। কেননা, শীতের রুক্ষতা ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজতে শুরু করে বসন্তে। গাছে গাছে নতুন পাতা, বাহারি রঙের ফুল আর পাখিদের কল-কাকলিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি।
প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই নতুন বছরের শুরু হিসেবে পালন করতো ব্যবিলনীয়ানরা। অবশ্য তখন বছর গণনা করা হতো চাঁদের উপর নির্ভর করে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠতো, শুরু হতো নতুন বছর আর বর্ষবরণ উৎসব। চলতো টানা ১১ দিন। ব্যাবিলনিয় সভ্যতার পর জাঁকজমকভাবে বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো রোমানরাও। তবে তাদের ছিল নিজস্ব ক্যালেন্ডার। যদিও সে ক্যালেন্ডারও রোমানরা তৈরী করেছিল চাঁদ দেখেই । আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের নববর্ষ ছিলো মার্চের প্রথম দিন। প্রথম দিকে তাদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল দশটি। ছিল না জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারী মাস। পরবর্তীতে সম্রাট নুমা পন্টিলিয়াস জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারীকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন।
সমস্যা ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে সেই সমস্যার সমাধান করেন অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস নামের একজন ডাক্তার তিনি তৈরী করেছিলেন নতুন আরেকটি ক্যালেন্ডার। মাত্র ৪০০ বছরের কিছু আগে ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে বাতিল ঘোষনা করে প্রচলন করেন এই ক্যালেন্ডারটির। যা বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবেই পরিচিত। বর্তমানে যেসকল দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা সকলেই পহেলা জানুয়ারী তারিখেই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে। ইতিহাসমতে, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্কটল্যান্ড, ১৭৫২ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলো নববর্ষের রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। ১৭০০ সাল হতে রাশিয়া এই রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের সূচনা হয়েছে। আধুনিক গ্রেগরিয়ান ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ১লা জানুয়ারি থেকে শুরু হয় নতুন বছর। মেসোপটেমিয় সভ্যতা (বর্তমান ইরাক) থেকে প্রথম নববর্ষ উদযাপনের সূচনা হয়। তবে রোমে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ অব্দে।পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন।আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ ইয়ার পালন শুরু হয় ১৯ শতক থেকে।
নতুন বছরের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর হচ্ছে নিউ ইয়ার ইভ। এদিন নতুন বছরের আগমনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ।ইংরেজি নতুন বর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন- ইসরায়েল। দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। তবে ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অ-ইহুদি উৎস হতে উৎপন্ন এই রীতি পালনের বিরোধী।আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকেই গ্রহণ করেনি। যেমন- সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এসব দেশ ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।
আমরা যে খ্রিস্ট বছর বা খ্রিস্টাব্দ বলি, তার সূচনা হয় আরো পরে। খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে গণনা করে ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রী ৫৩২ অব্দ থেকে সূচনা করেন খ্রিস্টাব্দের। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের কথা। রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিদদের পরামর্শে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করেন। তার নির্দেশে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাস থেকে দেওয়া হয় ১০ দিন। এর ফলে ঐ বছরের ৫ তারিখকে করা হয় ১৫ তারিখ।পরে পোপ গ্রেগরি ঘোষণা করেন, যেসব শতবর্ষীয় অব্দ ৪০০ দিয়ে বিভক্ত হবে সেসব শতবর্ষ লিপইয়ার হিসেবে গণ্য হবে। পোপ গ্রেগরি প্রববর্তিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মোটামুটি একটি নিখুঁত হিসাবে আমাদের পৌঁছে দেয়। বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। আজ আমরা যে ক্যালেন্ডার দেখে ইংরেজি বর্ষ হিসাব করি, উদযাপন করি নববর্ষ, তা সেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ফসল।