গাংনী বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার অন্তর্গত বর্তমানে একটি উপজেলা
১৯৮৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি একে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উপজেলার মোট আয়তন ৩৪৪.৪৭ বর্গ কিলোমিটার। এটি ১টি থানা, ১টি পৌরসভা (গ শ্রেণীর), ৯টি ইউনিয়ন, ১৩টি মহল্লা, ০৯টি ইউনিয়ন, ১০৩টি মৌজা, ১৪৩ টি গ্রাম নিয়ে গঠিত।
ইউনিয়নসমূহঃ
কাথুলী ইউনিয়ন, তেতুঁলবাড়ীয়া ইউনিয়ন, কাজিপুর ইউনিয়ন, বামন্দি ইউনিয়ন, মটমূড়া ইউনিয়ন, ষোলটাকা ইউনিয়ন, সাহারবাটি ইউনিয়ন, ধানখোলা ইউনিয়ন, রায়পুর ইউনিয়ন
ইতিহাসের পাতা থেকে
মেহেরপুরের আর এক প্রাচীন বসতি গাংনীর নামটি এ অঞ্চলের প্রাচীনতার ইঙ্গিতবহন করে
গাংনী নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের পরিচয়। গাংনী পদটিই এখানে প্রধান। নদী বা নদীর মৃতপ্রায় ধারাকে এ এলাকার মানুষ গাং বা গাঙ বলে। অনুমান করা হয় যে, গাঙ্গেয় অববাহিকার এ এলাকায় প্রথম বসতি স্থাপনকারী মানুষেরা অন্যদের বসবাসে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ‘এ এলাকায় গাং অর্থাৎ নদী নেই’- এমন ঘোষণা দেয়। ‘গাং নেই’ পরবর্তীকালে হয়ে যায়- ‘গাংনী’। এ এলাকার মানুষেরা নেই বুঝাতে ‘নি’ উচ্চারণ করে।
গাংনী নামকরণে ভিন্ন আর একটি যুক্তিও পাওয়া যায়। পশ্চিমে কাজলা নদী এবং পূর্বে মাথাভাঙ্গা নদীর মধ্যবর্তী দোয়ার অঞ্চলে এ থানার অবস্থান। সেই অর্থে এ নদীর প্রধান উৎস গঙ্গা। গঙ্গার কন্যা মনে করার কারণে খরস্রোতা মাথাভাঙ্গাকে একসময় এ এলাকার মানুষ ‘গাংগীনি’ বলে ডাকত। গাংগীনি থেকে গাঙ্গনী বা গাংনী শব্দের উৎপত্তি। গাংনী নামকরণে মুলত এ অঞ্চলের নদী সম্পৃক্ততার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
ছবি: টলেমির মানচিত্রে গাংনী
তবে পেরিপ্লাস ও টলেমির বর্ণনা থেকে জানা যায় আজকের বাংলাদেশ যে ভূভাগ নিয়ে গঠিত তা এক সময়ে (১৫০ খৃষ্টাব্দে) গঙ্গাঋদ্ধি (গ্রীক উচ্চারণে গঙ্গারিড্ডি) নামক একটি সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল, তার রাজধানী (অথবা, অন্ততঃ একটি প্রধান নগর) ছিল Gange. তা থেকে (অর্থাৎ গাঙ্গে>গাঙ্গী>গাংনী) গাংনীর নামকরণের সূত্র খোঁজাকে ভিত্তিহীন গণ্য করা যাবে না । নামকরণের এই প্রবণতা থেকে নামটির প্রাচীনত্ব সেই সূত্রে স্থানটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। (When Greek historian Periplus talks about India in the first century AD, apparently he speaks of Bangla. He says, “There is a river near it called the Ganges (Ganga)” … “On its bank is a market town which has the same name as the river, Ganges (Gange, Gamga). (Quote from Sudheer’s India’s Contribution to the World’s Culture located on the Web).
গাংনীর নাম করণে গাং বা নদীর সাথে সংযুক্ত থাকাটাই বেশী যুক্তিযুক্ত হলেও নামকরণের রীতিটি যে অনেক প্রাচীন তা মেহেরপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর অবসথান ও গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ জেলার প্রধান নদী ভৈরব অতি প্রাচীন কালের একটি নদী। প্রাগৈতিহাসিক কালে তো বটেই সামপ্রতিক ঐতিহাসিক কালপর্বেও এই নদীটির স্বাভাবিক নাব্যতা বজায় ছিল ।
নবাব আলীবর্দীখান বাগোয়ান ভ্রমণে এই নদী পথ ব্যবহার করেছিলেন। ভারতের করিমপুর থানার উজানে জলাঙ্গী নদীর সাথে ভৈরবের সংযোগ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এই নদীর তীরবর্তী জনপদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়। মেহেরপুর, গাংনী ও মুজিবনগরের প্রাচীন গ্রামগুলির সবগুলিই কোন না কোন নদী কিংবা নদীর সাথে সংযুক্ত বৃহদায়তন জলাশয় যা বিল বা দহ হিসেবে পরিচিত তার তীরে গড়ে উঠেছে। এসকল গ্রামগুলির মনুষ্যবসতিস্থল বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক গ্রামের মাটি খনন করলে পোড়ামাটির নানা সাংসারিক উপকরণ মনুষ্য-মূর্তির যে অবশেষাদি পাওয়া যায় সেগুলি নিয়ে কোন গবেষণালব্ধ তথ্য উপাত্ত পাওয়া না গেলেও ঐসকল মূর্তি ও গার্হস্থ্য উপকরণাদির গঠণ থেকে এবং বিশেষতঃ হরপ্পা-মোহেঞ্জারোতে প্রাপ্ত মনুষ্য-মূর্তির সাথে তাদের সাদৃশ্য থেকে এ ধারণা করা যায় যে সেগুলি এবং সেই সূত্রে তাদের উৎসস্থলগুলি অনেক প্রাচীন।
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো মেহেরপুরও ইংরেজ শাসনে চলে যায়। ১৭৮৭ সালে নদীয়া জেলা গঠিত হয়। মেহেরপুর নদীয়ার অন্যতম মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৫৪ সালে। সে সময় মেহেরপুরের থানা ছিল পাঁচটি: করিমপুর, গাংনী, চাপড়া, তেহট্ট ও মেহেরপুর। তবে মেহেরপুর ও গাংনী থানা হিসেবে প্রতিষ্টা লাভ করে তারও পূর্বে, ১৭৯৯ সালের দিকে। ১৮৯২ সাল থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত পার্শ্বর্তী চুয়াডাঙ্গা মহকুমা মেহেরপুর মহাকুমার সাথে সংযুক্ত ছিল।
মেহেরপুর শহরের প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৫০ সালের পরের ইতিহাস অনুসারে ঐ বছর নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ বাগোয়ানে মৃগয়া শেষে মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে ভৈরবনদে ঝঞ্ঝাক্রান্ত হয়ে রাজুগোয়ালিনির আশ্রয় গ্রহন করেন এবং রাজুর আতিথ্যে প্রীত হয়ে তার যাচঞা অনুযায়ী তাকে ভৈরবনদের পশ্চিমতটস্থ সমুদয় ভূমি দান করেন। এই ভূমির নামকরণ করা হয় রাজপুর। এই রাজা গোয়ালা চৌধুরী খেতাব প্রাপ্ত রাজুর পুত্র মেহেরপুর শহরের গোড়াপত্তন করেন।
District Gazetteers অনুসারেঃ [Establishment of Meherpur town:] In 1750, Alibardi Khan, the governor of the province, came to Bagwan with a Shikar party. One evening during the return voyage along the river Bhairab, a tornado raged furiously and sank some of his boats. The journey had to be abandoned and the Nawab and his men took shelter in a house of a milk-maid, a widow named Raju Ghosani. The widow looked after the comforts of the Nawab and served him and his chira, curd gur and bananas. The Nawab was very much pleased with the humble service of this widow and enquired what reward suits her. Raju Ghosani prayed for the granting of a grazing field for her 100 cattle. The noble Nawab, at once, granted her the entire portion of the pargana Bagwan that lies on the eastern side of the river Bhairab. The Nawab named this portion of the pargana Bagwan as (pargana) Rajpur after the name of Raju Ghosani. The son of the widow was granted the title of Raja Goala Chowdhury. This Raja developed Meherpur, which grew into a prosperous town. The riches of Meherpur soon attracted the attention of the greedy Marhatta plunderers, who ransacked the town on several occasions. Their brutality and cruelty ruined Meherpur. Being defeated again and again, the Raja and his nobles constructed secret hide-outs wherein they could take shelter at the time of raids.
এ প্রসঙ্গে ১৩১৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত কুমুদনাথ মল্লিক রচিত নদীয়া কাহিনী তে মেহেরপুরের কথা উল্লেখ হয়েছে ,বহু পূর্ব্বে মেহেরপুরে গোয়ালাচৌধুরী উপাধী-ভূষিত সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিগন বাস করিতেন; ইঁহাদের প্রধান ছিলেন রাজা রাঘবেন্দ্র ও রাজুঘোষাণী (ইহার নাম হইতে রাজপুর পরগণার নাম হইয়াছে।) তাঁহাদের স্বাক্ষরিত সনদ, কোবালা , দানপত্র প্রভৃতি দলিলাদি অনেক গৃহস্থের ঘরে আছে। কথিত আছে বর্গীর হাঙ্গামাকালে মহারাষ্ট্রগণের অন্যতম নেতা রঘুজি ভোঁসালার সহিত যুদ্ধে এই বংশীয়েরা সপরিবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েন। চৌধুরীদিগের নিধনের পর বহুদিন তাঁহাদের অধিকৃত মেহেরপুরের অন্তর্গত প্রাসাদোপম অট্টালিকাদি ক্রোশৈকদূরস্থ সুবিস্তীর্ণ গড়ভূমি, দীর্ঘিকা ইত্যাদি বনাকীর্ণ হইয়া ছিল, এবং প্রয়োজন হইলেও কেহ কখন ইহার ইষ্টকাদি ব্যবহার করিত না।
সাধারণের মনে ইহাই দৃঢ় সংস্কার ছিল যে, চৌধুরী বংশের ইষ্টকাদি লইলে কাহারও শুভ হয় না; কিন্তু ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে এখানে মিউনিসিপালটী স্থাপিত হইলে এই আবাসভূমির মধ্যেই মিউনিসিপাল আপিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, পোষ্টাফিস, জমীদারী কাছারি এবং দুই এক ঘর গৃহস্থেরও বাটী নির্ম্মিত হইয়াছে। দীর্ঘিকাটি মিউনিসিপালিটি কর্তৃক পুনঃসংস্কৃত হইয়া পানীয় জলের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইতেছে। বর্তমান কালে এই আবাস বাটির অনতিদূরে একটি সুগঠিত প্রাচীন শিবমন্দির এবং গোয়ালা চৌধুরীদিগের একটি কালীমন্দির আজও বিদ্যমান আছে।
প্রাতঃস্মরণীয় রাণী ভবানী যখন রাজপুর পরগণার অধিকারিণী হয়েন, তখন মেহেরপুরেরও তিনি অধিশ্বরী হয়েন। রাণী ভবানীর হস্ত হইতে মেহেরপুর কাশিমবাজারাধিপতি হরিণাথ কুমারের হস্তে আসে। পরে (১৮৪১ খৃ.?) হরিনাথের পুত্র রাজা কৃষ্ণনাথ এই ডিহি মেহেরপুর James Hill নামক এই দোর্দণ্ড প্রতাপ নিলকুঠিয়ালকে পত্তনী দেন।
ছবি: ভাটপাড়া নীলকূঠির একাংশ
তথ্যসুত্র: উইকিপিডিয়া/ ইন্টারনেট