মিশরে পুরাতত্ত্ববিদরা সাক্কারায় এমন একটি মমি খুঁজে পেয়েছেন যা সোনার পাত দিয়ে মোড়া এবং চার হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো।
রাজধানী কায়রোর দক্ষিণে সাক্কারায় একটি প্রাচীন কবরস্থানে মাটির ৫০ ফুট নিচে এটি পাওয়া যায়।
পুরাতত্ত্ববিদরা বলছেন, সোনার পাতে মোড়ানো মমিটি হেকাশেপেস নামে একজন লোকের। মিশরে কোন রাজা বা রাজপরিবারের নয় এমন ব্যক্তিদের যত মমি পাওয়া গেছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এবং প্রাচীনতম মমিগুলোর একটি ।
যে শবাধারে মমিটি রাখা ছিল তা গত ৪,৩০০ বছরে কখনো খোলা হয়নি।
একই জায়গাটিতে আরো তিনটি সমাধি পাওয়া গেছে এবং তার মধ্যে একটি একজন ‘গোপন রক্ষকের’ বলে বলা হচ্ছে।
এই জায়গাটিকে বলা হচ্ছে একটি প্রাচীন ‘নেক্রোপলিস’ বা মৃতদের নগরী। এখানে সবচে বড় যে মমিটি পাওয়া যায় তা ‘খনুমদিয়েদেফ’ নামে এক ব্যক্তির – যিনি ছিলেন একজন পুরোহিত, পরিদর্শক এবং অভিজাতদের তত্ত্বাবধানকারী।
অন্য আরেকটি মমি ‘মেরি’ নামে এক ব্যক্তির – যিনি ছিলেন প্রাসাদের একজন কর্মকর্তা যাকে ‘গোপন রক্ষক’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। এ পদবী পাবার ফলে তার বিশেষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো করার অধিকার ছিল।
তৃতীয় কবরটিতে সমাহিত করা হয়েছিল ‘ফেটেক’ নামে একজন বিচারক ও লেখককে। এখানে বেশ কিছু মূর্তি পাওয়া গেছে যা ওই এলাকায় পাওয়া মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের।
এ ছাড়া মৃৎপাত্রসহ আরো নানা জিনিস পাওয়া গিয়েছে ওই কবরগুলো থেকে ।
মিশরের সাবেক প্রত্নসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং পুরাতত্ত্ববিদ জাহী হাওয়াস বলছেন, নতুন পাওয়া এই মমি এবং অন্যান্য সামগ্রীর সবই খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫তম থেকে ২২তম শতাব্দীর সময়কালের।
“এ আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ – কারণ এর মাধ্যমে তখনকার রাজাদের আশপাশে থাকা লোকদের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে“ – বলেন এই খননকাজের সাথে জড়িত আরেকজন পুরাতত্ত্ববিদ আলি আবু দেশিশ।
প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র সাক্কারা
কায়রোর নিকটবর্তী সাক্কারা নামের জায়গাটি তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি সমাধিক্ষেত্র হিসেবে চালু ছিল।
ইউনেস্কো এই জায়গাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান বলে ঘোষণা করেছে।
এখানেই একসময় মিশরের প্রাচীন রাজধানী মেম্ফিস নগরী অবস্থিত ছিল। তা ছাড়া এখানে আছে এক ডজনেরও বেশি পিরামিড।
এই পিরামিডগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিঁড়ির মত ধাপবিশিষ্ট ‘স্টেপ পিরামিড’ – আর এটির কাছেই সবশেষ এই মমিগুলো পাওয়া গেছে।
সাক্কারার মমিগুলো পাওয়ার মাত্র একদিন আগেই মিশরের দক্ষিণাঞ্চলীয় লাক্সর শহরের বিশেষজ্ঞরা বলেন তারা এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের রোমান যুগের একটি পূর্ণাঙ্গ শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন।
তারা বলছেন এখানে আবাসিক ভবন, টাওয়ার, এবং বিভিন্ন রকম পাত্র, যন্ত্রপাতি এবং রোমান মুদ্রাসহ একটি ধাতব কারখানা বা ওয়ার্কশপ পাওয়া গেছে।
আরো পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টায় মিশর
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিশর তাদের পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করে তুলতে অনেকগুলো বড় বড় পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করেছে।
বেশ কিছুকাল বিলম্বের পর মিশরের সরকার এ বছরেই ‘গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর উদ্বোধনের আশা করছে। বলা হচ্ছে ২০২৮ সাল নাগাদ ৩ কোটি পর্যটক এটি দেখতে আসবে।
তবে কিছু সমালোচক অভিযোগ করেছেন যে মিশরের সরকার পর্যটক বাড়ানোর জন্য একাডেমিক গবেষণার পরিবর্তে মিডিয়ায় প্রচার পায় এমন আবিষ্কারগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
‘সবুজ কফিন’
জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমে আমেরিকা থেকে ‘সবুজ কফিন’ মিশরে ফেরত যাবার খবরটি ব্যাপক প্রচার পায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে ৩৩২ সাল পর্যন্ত মিশরে যে রাজবংশ রাজত্ব করেছিল – সাড়ে নয় ফুট লম্বা সবুজ এই কফিনটি সেই সময়ের । এতে একদা শায়িত ছিলেন আখেনমাট নামে একজন পুরোহিত। কফিনটির মূল্য ১০ লাখ ডলারেরও বেশি বলে ধরা হয়।
উত্তর মিশরের আবু সির নেক্রোপলিস থেকে একটি পাচারকারী চক্র এটিকে চুরি করেছিল এবং তার পর ২০০৮ সালে এটি জার্মানি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায়।
এর পর ২০১৩ সালে একজন সংগ্রাহক এটিকে হিউস্টন মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল আর্টস-কে প্রদর্শনের জন্য ধার দেন। পরে এটি নিয়ে কয়েক বছর ধরে মামলা চলার পর যুক্তরাষ্ট্র এটি মিশরকে ফেরত দেয় এবছর ২রা জানুয়ারি।
এর আগে ২০১৯ সালে ‘সোনালি কফিন’ বলে পরিচিত পাওয়া প্রায় ২,১০০ বছরের পুরোনো আরো একটি পাচার-হওয়া শবাধার মিশরকে ফেরত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট এটি ৪০ লাখ ডলারে কিনেছিল।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় আরো কিছু দেশ সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী মিশরকে ফেরত দিয়েছে।
২০২১ সালে ইসরায়েল মোট ৯৫টি প্রত্নসামগ্রী মিশরকে ফেরত দেয়। সেগুলো নানা পথে ইসরায়েলে পাচার হবার পর জেরুসালেমে বিক্রি করা হচ্ছে বলে ধরা পড়েছিল।
সম্প্রতি আয়ারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও ঘোষণা করেছে যে তারা একটি সারকোফেগাস বা শবাধার, মমি এবং কিছু পাত্র মিশরকে ফেরত দেবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা