হাজার হাজার বছর ধরে, সমস্ত সেলাই হাত দ্বারা করা হয়েছিল
সূচিশিল্পের অপরিহার্য অনুষঙ্গ সুই বহু ব্যবহারে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেললেও আধুনিক পৃথিবীর বিকাশে রয়েছে এর অপরিহার্য অংশগ্রহণ। ঝলমলে ফ্যাশন জগতের আজকের যে দুনিয়া তা তৈরি হতো না যদি সুইয়ের নিরব ভূমিকার ফলে বিশ্বজুড়ে বিশাল এক শিল্প গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র এই একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত একটা অনুসঙ্গকে কেন্দ্র করে।
সেলাই হলো সূঁচ এবং সুতা সাহায্যে তৈরি সেলাই ব্যবহার করে বস্তুকে সংযুক্তকরণ বা সংযুক্তকরণের নৈপুণ্য। প্যালিওলিথিক যুগে উদ্ভূত টেক্সটাইল আর্ট অন্যতম প্রাচীন সেলাই। স্পিনিং সুতা বা বুননের কাপড়ের আবিষ্কারের আগে, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিশ্বাস করেন যে ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে স্টোন যুগের লোকেরা হাড়, অ্যান্টিলার বা হাতির দাঁত সূঁচ এবং সাইনু, ক্যাটগুট এবং শিরা সহ প্রাণীর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে তৈরি “থ্রেড” ব্যবহার করে পশম এবং ত্বকের পোশাক সেলাই করে।
নিত্য ব্যবহারে অতি তুচ্ছ বস্তুতে পরিণত হওয়া সুঁইয়ের আছে প্রাচীনতম এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস
ব্রোঞ্জ যুগে ধাতু দিয়ে ছোট, বড় বিভিন্ন আকৃতির সুই তৈরি হয় এ সময়ে। গ্রীসে তখন বড় সুই দিয়ে নারীদের দীর্ঘ পোশাকের ঝুল সেলাই করা হত। লৌহ যুগে রোমানরা লোহা এবং হাতির দাঁতের সুই ব্যবহার করতো। তখন রুপার তৈরি সুইও ব্যবহৃত হত বিভিন্ন রাজকীয় কাজে। ব্রোঞ্জ যুগে বসবাসকারী পেরুর অধিবাসীদের সমাধিতে রূপার তৈরি সুই পাওয়া গেছে।
সুই খুব তুচ্ছ একটা প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ সুঁই
পঁচিশ হাজার বছর পুরনো গ্রাভেটিয়ান সভ্যতায়ও ফুটোসহ সুইয়ের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এ সময়ে মানুষ মাছের কাটা, কাঠ এবং হাতির দাঁত দিয়ে সুই তৈরি করতো এবং সেগুলো ছিল ভারী এবং মোটা। অনেক সুইয়ের শেষ প্রান্তে বা মাঝখান ফুটো থাকলেও বেশির ভাগ সুইয়ের পিছন দিকে একটা বাকানো হুকের মত থাকত।
প্রাগৈতিহাসিক সময়ে মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ের সাথে সাথে নিতান্ত প্রয়োজনে যে শিল্পটি গড়ে উঠেছিল তা হল সূচিশিল্প।
সুই আর সুতোর সম্মিলনে এই শিল্প ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। আধুনিক সভ্যতার বিকাশে এই শিল্পের ভূমিকা যদিও আমরা অনুভব করতে পারি না, কিন্তু সুই-সুতোর কাজ হাজার বছরের পুরনো এক শিল্প। এই শিল্পের বয়স কম করে হলেও বিশ হাজার বছরের পুরোনো আর এর মূল অনুষঙ্গ সুইয়ের রয়েছে আরও পুরনো ইতিহাস। কোন লিখিত প্রমাণ না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় চল্লিশ হাজার বছর পুরনো প্রাচীন-প্রস্তর যুগে অর্থাৎ প্যালিওলিথিক সময়েও সুইয়ের ব্যবহার ছিল।
পঁচিশ হাজার বছর পুরনো গ্রাভেটিয়ান সভ্যতায়ও সুইয়ের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এ সময়ে মানুষ মাছের কাটা, কাঠ এবং হাতির দাঁত দিয়ে সুই তৈরি করতো এবং সেগুলো ছিল ভারী এবং মোটা। অনেক সুইয়ের শেষ প্রান্তে বা মাঝখান ফুটো থাকলেও বেশির ভাগ সুইয়ের পিছন দিকে একটা বাকানো হুকের মত থাকত।
ধ্রুপদী যুগের শুরুতেও নকশা করা কাপড় পরার রীতি চালু ছিল। তখনো নারীরা সুই সুতো ব্যবহার করে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলতো কাপড়ে। গুপ্ত রাজত্বে সেলাই করা কাপড় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সুন্দর সেলাই করা পোশাক এবং তাতে নকশা ছিল রাজকীয় প্রতীক। বৈদিক যুগ থেকে প্রচলিত উত্তরীয় ধীরে ধীরে নারীদের বিশেষ পোশাক ঘাগরায় রূপান্তরিত হয়। সিন্ধু উপত্যকায় নারীদের শুধু মাত্র নিচের অংশে কাপড় পরিধান করতে দেখা যেতো কিন্তু উপরের অংশ থাকত খোলা। যদিও ময়ূর সাম্রাজ্যের আগে থেকেই নারীরা উপরের অংশে সেলাই করা বস্ত্র পরিধানে অভ্যস্ত ছিল।
গুপ্ত আমল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত সুই সুতার বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সিন্ধু সভ্যতায় কাপড় সেলাই করে পরিধানের প্রচলন ছিল অর্থাৎ সুই সূতার ব্যবহার আমরা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতাতেও লক্ষ্য করি।
অন্যদিকে নৃতত্ত্ববিদদের মতে চীনারা প্রথম উপযুক্ত স্টিলের সুই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
যদিও অনেক গবেষক মনে করেন এর মূল উৎস ভারত। আবার আব্বসিয় যুগে আরব ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধাতু সংগ্রহ করে নিজেরাই তা থেকে উন্নতমানের ধাতব জিনিস বানাতে সক্ষম ছিলেন। তারা উন্নত প্রযুক্তির লোহার মিশ্রণ সংগ্রহ করতো যা ভারতে তৈরি স্টিলের মত ছিল। তারা তা থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় এবং সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করতো। তার মধ্যে ছিল বিভিন্ন আকৃতির সুই। দামেস্ক এবং তালেদু’র বিখ্যাত অস্ত্র তৈরির কারখানায় তারা এসব তৈরি করতো।
পশুর চামড়া সেলাই করতে সুই ছিল অন্যতম আবিষ্কার। নতুন বসতি স্থাপনেও সুই ও সেলাইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু প্রয়োজন মেটাতেই আদিম মানুষ সুইয়ের ব্যবহার করেনি, সামাজিক প্রয়োজনেও সুই হাতে নিয়েছিল তারা।
ব্রোঞ্জ যুগে সুইয়ের আকারে আসে পরিবর্তন। ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির সুই তৈরি হয় এ সময়ে। গ্রিসে তখন বড় সুই দিয়ে নারীদের দীর্ঘ পোশাকের ঝুল সেলাই করা হতো। লৌহ যুগে রোমানরা লোহা ও হাতির দাঁতের সুই ব্যবহার করত। তখন রুপার তৈরি সুইও ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন রাজকীয় কাজে।
বিংশ শতাব্দীতে সেলাই মেশিন
বিংশ শতাব্দীতে সেলাই মেশিনের আবিষ্কার এবং কম্পিউটারাইজেশনের উত্থানের ফলে সেলাই করা বস্তুর ব্যাপক উৎপাদন ও রফতানি ঘটে, তবে হাতের সেলাই বিশ্বজুড়ে এখনও প্রচলিত রয়েছে।সূক্ষ্ম হাতের সেলাইয়ের বৈশিষ্ট্য উচ্চমানের টেইলারিং, হিউট কৌচার ফ্যাশন এবং কাস্টম ড্রেসমেকিং এবং সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে টেক্সটাইল শিল্পী এবং শখবিদ উভয়ই তা অনুসরণ করে।“সেলাই” শব্দের প্রথম পরিচিত ব্যবহার ছিল ১৪ তম শতাব্দীতে।
সুতার ইতিহাস বলতে সুতা ঠিক কত বছর আগে আবিষ্কার তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেননি।
সুতা হচ্ছে বুনন প্রক্রিয়ার মূল উপকরন। বস্ত্র উৎপাদনের জন্য একগুচ্ছ তন্তুকে পাক বা মোচড় দিয়ে একত্রে সন্নিবেশ করে যা তৈরি করা হয় তাই সুতা।
তবে মেক্সিকোর বিভিন্ন গুহাগুলো সন্ধানকারী বিজ্ঞানীরা সুতার বোল এবং তুলা কাপড়ের টুকরা খুঁজে পেয়েছিলেন যা পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয়েছে যে সেগুলো কমপক্ষে ৭,০০০ বছর পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর পূর্বে পাকিস্তানের সিন্ধু নদী উপত্যকায়, তুলার চাষ করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত সুতা ব্যবহার করে কাপড়ে বোনা হত। প্রায় একই সময়ে, মিশরের নীল উপত্যকার আদিবাসীরা সুতার পোশাক তৈরি শুরু করে। আরব ব্যবসায়ীরা সুতা কাপড় ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল।এরই ধারাবাহিকতায়, ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পরে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে তুলা গাছ জন্মাতে দেখা যায়।
১৫০০ সালের মধ্যে, সুতা বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয় ১৫৫৬ সালে ফ্লোরিডায় এবং ভার্জিনিয়ায় ১৬০৭ সালে তুলার বীজ রোপণ করা হয়েছিল। কলোনিস্টরা ১৬১৬ সালের মধ্যে, ভার্জিনিয়ার জেমস নদীর তীরে তুলা চাষ শুরু করেছিলেন। এরপর, ১৭৩০ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমবারের মতো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তুলা থেকে সুতা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলার জিন আবিষ্কারের ফলেই আজ বিশ্ব বাজারে তুলার এত চাহিদা। এলি হুইটনি ১৭৯৩ সালে সুতির জিনের পেটেন্ট আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও পেটেন্ট অফিসের রেকর্ড থেকে বোঝা যায় যে হুইটনির পেটেন্ট আবিষ্কারের দু’বছর আগে নোট হোমস নামে একজন মেশিনবিদ প্রথম সুতির জিন তৈরি করেছিলেন। দ্রুত বর্ধনশীল জিন টেক্সটাইল শিল্পকে প্রচুর পরিমাণে সুতি সরবরাহ করা সম্ভব করেছে। ১০ বছরের মধ্যে, মার্কিন তুলা ফসলের মূল্য $১৫০,০০০ থেকে বেড়ে ৮ মিলিয়নেরও বেশি হয়েছে।