অভিজ্ঞতা আর আত্ম-অনুভবই হচ্ছে ছোটগল্পের প্রাণ। সেই অভিজ্ঞতায় পরিব্যপ্ত জীবনকে স্পর্শ করে তাকে আখ্যান-বর্ননার ভেতরে এনে গল্পের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন হাবিব আনিসুর রহমান। গল্পটি অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ আর অনুভবের অনুপম নির্যাসে উজ্জ্বল। পাঠক অবধাতিভাবেই এই গল্পটিতে পাবেন আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার নানান বিচ্ছুরণের একটি। গল্প লেখার বিষয় নয়, গল্প ঘটে থাকে আমাদের চারপাশে। লেখা মানে তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা মাত্র। হাবিবের ভাষা মেদহীন। তাঁর গল্পে পাঠক এক অন্যরকম স্বাদ পাবেন।
কমরেড এসেছিলো
হাবিব আনিসুর রহমান
মিষ্টিসুরে বেজে উঠলো ডোরবেলটা। যেনো ছোট্ট একটা পাখি ঘরের ভেতর ঢুকে মনের ছন্দে গান ধরেছে। গতকাল রেবেকার ইচ্ছাতেই পুরনো বেলটা পাল্টানো হয়েছে। আগের বেলটা টিপলেই কেমন একটা বিশ্রী কর্কশ শব্দ হতো− ঘেরর ঘেরর।
সাত সকাল বেল টিপলো কে? এখন সবারই তাড়াহুড়ো, অনেক কাজ একসঙ্গে সামনে এগিয়ে চলার সময় এটা। মেয়ে দুটোর স্কুল। ওদের নাস্তা, স্কুলের টিফিন। জামা জুতো পাল্টানো, বইপত্র গোছানো, বাথরুমও আছে এই সময়টুকুর মধ্যে। তার সাথে আমার সেভ, গোসল, এটাওটা খুঁজে না পাওয়া এগুলোও যোগ হয় ওসবের সাথে। সব মিলিয়ে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড। নাস্তানাবুদ হবার সময়। রেবেকা শুধু দৌড়ায় আর থেকে থেকে আচমকা চিৎকার ছুড়ে দেয় আর্মি কমান্ডের মতো, রোজিনার মা অথবা আমাকে, ‘শুনছো একটু দেখোতো।’ হয়তো বড়ো মেয়েটা বললো, আম্মু আব্বুতো শুয়েই আছে এখনো। আর যাই কোথায়, ফেটে পড়ে রেবেকা, সংসারটা যেনো আমার একার। ঠিক তখনই পিলে চমকে ওঠে আমার। কারণ যে কোনো মহিলার ঘ্যানর ঘ্যানর আমি ভীষণ ভয় পাই। তার চেয়ে ভালো, কষ্ট করে বিছানা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে বসে থাকা। এই পরিবারের নীরব অথচ ভয়ঙ্কর একটা শাসন বজায় থাকে রেবেকার। তার শাসনের বাইরে যাওয়া বড্ড কঠিন ব্যাপার।
রোজিনার মা মেয়ে দুটোকে নিয়ে স্কুলে ছুটলো। পেছন পেছন রেবেকা। দরোজা খুলেই দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। পরনে কালো ট্রাউজার। গায়ে সাদা শার্টের ওপর একটা বেখাপ্পা কোট। পায়ে জুতোর বদলে চামড়ার চটি। মুখে চাপদাড়ি। ঝলসানো চেহারার শক্ত কঠিন মুখ। লোকটা বললো−
‘এটা এঞ্জিনিয়ার শহীদ সাহেবের বাসা?’
‘হ্যাঁ, রেবেকা একটু রুক্ষ গলায় বললো।’
‘উনি আছেন?’
‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন?’
পাল্টা প্রশ্ন শুনে লোকটা থতমত খেয়ে বললো−
‘আমি এখানেই থাকি। দেশের বাড়ি মেহেরপুর।’
রেবেকা এবার দরোজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বললো−
‘একটু দাঁড়ান।’
ঘরে ঢুকে বেশ বিরক্তির সাথে রেবেকা বললো,
‘দেশ থেকে লোক এসেছে গিয়ে দেখো, আসার আর সময় পেলো না।’
‘বসতে বলেছো?’ আমি বললাম।
‘যাকে তাকে বসতে বলবো। চেনা নেই, জানা নেই। আজকাল এরকম হঠাৎ আসা লোকজন কতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। খবরের কাগজে দেখছো না! লোকটাকে দেখে মনে হলো ভবঘুরে।’
দেশ থেকে লোক এসেছে। তাড়াহুড়ো করেই ছুটলাম। গিয়ে দেখি দরোজায় দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক। বয়স আমার মতোই হবে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। সে হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। চিনতে না পেরে বললাম।
‘আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?’
লোকটার মুখে তখনো নির্মল হাসি। ডান হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘মধু আমি বা”চু। আনন্দবাস গ্রামের বাচ্চু, চিনতে পেরেছো?’
আমার ডাকনাম ধরে ডাকলো লোকটা। বহুকাল পর ওর মুখে আমার ছেলেবেলার নামটা শুনে বুকটা নেচে উঠলো। বিদ্যুৎ চলে যাবার পর আবার অন্ধকারে হঠাৎ বিদ্যুৎ আসলে যেমন সবকিছু আলোকিত হয়ে ওঠে, তেমনই হঠাৎ যেনো আমার ছেলেবেলাটা ঝলসে উঠলো। এগিয়ে দেয়া হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
‘বাচচু! কী আশ্চর্য ব্যাপার, হঠাৎ তুমি! এখানে এলে কী করে? এসো এসো।’
হাত ধরে বা”চুকে ড্রইংরুমে এনে বসালাম। হিসাব করে দেখলাম বিশ বছর পর দেখা। চিনতে অসুবিধা হলো না। চেহারার সেই দ্যুতিটা একদম নেই। পোড়াপোড়া ছন্নছাড়া ভাব। আমাদের দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে। ক্লাস নাইন থেকে কলেজ পর্যন্ত একই সঙ্গে পড়েছি আমরা। কলেজে পড়ার সময় ও দারুণ আকর্ষণীয় ছিলো। হবু নেতা। ওর সাথে ভাব করতে চাইতো সবাই। তখন থেকেই একটা বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত ছিলো। আমরা যারা ওর বন্ধু ছিলাম, তারা ওকে কমরেড বলে ডাকতাম। তিরিশ বছর আগের কথা। ওর সাথে দেখা হওয়াতে খুব আনন্দ লাগলো আমার। বললাম,
‘ঠিকানা পেলে কোথায়?’
একগাল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বা”চু বললো,
‘কুষ্টিয়ার এক ভদ্রলোকের কাছে শুনলাম তুমি এখানে আছো। বাসার ঠিকানাটাও ওই ভদ্রলোক দিলেন। চলে এলাম। চারপাশে তাকালো। বা”চু বললো, ভাােই আছো বেশ। চমৎকার গোছানো ঘর।’
হঠাৎ স্কুলের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো আমার। প্রাণখোলা একটা হাসি দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। স্কুলের নাটকে অভিনয় করার সময় কাশেম নামে এক ছেলেকে প্রচÐ জোরে চড় দিয়েছিলো বা”চু। অথচ রেহার্সেলের সময় আলম স্যার বার বার বলে দিয়েছিলেন, চড়টা খুব আস্তে মারবে। কাশেম ভিলেনের পার্ট করছিলো, তার শয়তানি অভিনয়ে দর্শকরা তখন চরম উত্তেজিত। মে এলো নায়ক বাচ্চু। প্রচন্ড জোরে চড় কষালো ভিলেনকে। এক চড়ে মাথা ঘুরে স্টেজের ওপর পড়ে গেলো ভিলেন কাশেম। দর্শকরা তখন উল্লসিত। হই হই করছে। কাশেম পড়ে যাওয়াতে আলম স্যার পড়লেন মহা সমস্যায়। প্রথমটায় ডায়ালগ পরিবর্তন করে কোনোরকমে ম্যানেজ করেছিলো সেই দৃশ্যটা। ঐ নাটকে আমিও অভিনয় করেছিলাম। কাশেমের পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি মনে পড়তেই আমি বলতে যাচ্ছিলাম, স্কুলের সেই নাটকের কথা তোমার মনে আছে বাচ্চু?
আমি বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। রেবেকাকে ডাকলাম। রেবেকা এলো, তবে দেরীতে। বা”চুর দিকে হাত তুলে বললাম− বাচ্চু, আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েছি বহুদিন। ও আর্টসে, আমি সায়েন্সে ছিলাম। কলেজে ওর দারুণ খ্যাতি ছিলো। আমরা ওকে কমরেড বলে ডাকতাম। বা”চু উঠে দাঁড়িয়ে রেবেকাকে সালাম দিলো। কিš‘ রেবেকা কোনো সৌজন্য না দেখিয়ে আমার মুখের ওপর বললো, কই কখনো তো তোমার কাছে তার নাম শুনিনি। আমি বিব্রত বোধ করলাম। তবুও হেসে বললাম, দেখা সাক্ষাৎ নেই বহুকাল, ভুলেই গিয়েছিলাম। একটু চা দাও আমাদের। রেবেকা চলে গেলো। আমি বা”চুর দিকে মুখ ফেরালাম।
‘চট্টগ্রামে কতোদিন এসেছো, কী করছো বলো?’
‘করছি না কিছুই, তবে একটা কিছু করবো বলে এখানে এসেছি।’
‘মটির নিচ থেকে ওপরে উঠে এলে কবে?’
‘মটির নিচ থেকে! অবাক হয়ে বা”চু তাকালো আমার দিকে।’
‘বুঝতে পারলে না? একটু হেসে বললাম, মাটির নিচ মানে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স-এর কথা বরছি।’
খুব জোরে হো হো করে হেসে উঠলো বা”চু। বললো,
‘ও এই কথা, বছর সাতেক আগেই সব শেষ।’
‘বিয়ে-শাদি করেছো, নাকি লাইফ লং ব্যাচেলর?’
‘শেষ পর্যন্ত করলাম তো।’
‘বাসা কোথায়?’
‘এই তো সামনের পাহাড়রটার ওপারে জামাল খান রোড, ওখানেই ফাইভ স্টার সেলুন নামে একটা চুল কাটার দোকান আছে। ওটার দোতলায় আছি আপাতত।’
‘কিছু করছো না তো খাচ্ছ কি?’
‘আমার বউ ছোটোখাটো একটা চাকরি করছে। প্রাইভেট ফার্মে। মিনুর কথা মনে পড়ে? আমরা যখন সেকেন্ড ইয়ারে ও তখন ফার্স্ট ইয়ার আর্টসে ছিলো। গণসঙ্গীত গাইতো।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শ্যামলা, পাতলা গড়ন, তোমার সাথে ঘুরতো, ওকেই বিয়ে করেছো তুমি, কী মজার ব্যাপার।’
‘বিয়ে করেছি মানে− ওর বাবা-মা দিতে চাননি। চাকরি বাকরি নেই। শরীরে গোপন রাজনীতির গন্ধ, কে মেয়ে দেবে বলো?’
‘তাইতো! বিয়েটা হলো কি করে?’
‘আমি যখন পালিয়ে বেড়াতাম, চিঠিতে মিনুর সাথে যোগাযোগ ছিলো কিছুদিন, পরে সেটাও কেটে গেলো। ফিরে আসার পর দেখলাম তখনো মিনু বিয়ে করেনি, অপেক্ষা করে আছে আমার জন্যে।’
‘তাজ্জব মেয়ে।’
‘শেষ পর্যন্ত মিনুর ইচ্ছেতে বিয়েটা করতে হলো, তাও কোর্টে।’
‘কবে?’
‘বছর পাঁচেক আগে।’
‘তোমাদের ছেলেমেয়ে?’
‘নিইনি। তবে এবার মনে হয় বাবা হয়ে যাচ্ছি। এটাও মিনুর ইচ্ছায়।’
‘কেনো, এমন করছো কেনো?’
‘বিয়ের পর অনেক কষ্টে ঢাকাতে পার্টনারশিপে একটা বই আর পত্র-পত্রিকার দোকান দিয়েছিলাম। পার্টনারশিপের ব্যবসা নানান সমস্যা। পার্টনার আমার সই জাল করে সব টাকা উঠিয়ে নিয়ে বিদেশে ভাগলো। ওখানে বেশ কিছু টাকা লস হয়ে গেলো। তারপর আর দাঁড়াতে পারিনি। চট্টগ্রামে মিনুর চাকরি হলো, চলে এলাম।’
‘এভাবে লস খেয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত। ভেরি স্যাড। তোমার সেই কবিতা লেখা, প্রলেতারিয়েত ভাবনা, গণসঙ্গীত এসব এখন আছে নাকি মাঠে মাঠে ঘুরে ঘুরে সব শেষ।’
‘আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা যে ঘুড়িটাকে কেন্দ্র করে ভেসে বেড়াতো আকাশে, তার সুতোর বন্ধনটা এখন আর নেই, কেটে গেছে। একদিন যা কিছু মনেপ্রাণে ঘৃণা করতাম, এখন বাঁচার জন্যে ওগুলোকও মেনে নিয়েছি।’
রোজিনার মা দুকাপ চা আর বিস্কুট এনে রাখলো আমাদের সামনে। বা”চুকে বললাম, নাও চা খাও। সে বিস্কুট খেতে লাগলো। খেতে খেতে প্রায় সবগুলো বিস্কুটই খেয়ে নিলো। পানি খেলো ঢকঢক করে। তারপর তৃপ্তির সাথে চা খেতে লাগলো। চা খেয়ে হঠাৎ বা”চু বললো− মধু, সিগারেট খাও এখনো? বললাম− খাই, তবে বউ-বা”চারা ঝামেলা করে ভীষণ। খেতে দেয় না। ঘরের ভেতর গিয়ে ড্রয়ার থেকে ঠিকাদারদের দেয়া এক প্যাকেট বেনসন হেজেস এনে রাখলাম ওর সামনে। দ্রæত প্যাকেটটা খুলে ও একটা স্টিক ধরালো। চোখ বুজে টানতে লাগলো। সোফার ওপর গা এলিয়ে দিলো। হঠাৎ জানতে চাইলো,
‘বাড়ি-টাড়ি করেছো নাকি?’
‘বাড়ি করতে পারিনি, তবে ঢাকাতে সাড়ে তিন কাঠার একটা প্লট আছে। ইনশাল্লাহ সামনের বছর কনস্ট্রাকেশনে হাত দেবো।’
‘তোমাদের বাড়ি হবে। এঞ্জিনিয়ার মানুষ অভাব কিসের বলো।’
আমার অফিসের সময় ঘনিয়ে আসছে। আজ মনে হয় লেট হবে। ভেতর ভেতর একটু অ¯ি’র হয়ে পড়লাম। বা”চু উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আসি মধু, একদিন এসো আমার গরিবালয়ে। মিনু কিš‘ তোমার কথা ভোলেনি।’
‘বাসাটা কোথায়?’
‘এইতো পাহাড়টার ওপারেই। জামাল খান রোড। দেখবে চুল টাকার দোকান, নাম ফাইভ স্টার ফেলুন। ওটার দোতলায়। এসো একদিন, কেমন?
বা”চুকে বিদায় দিয়ে আমি তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। গোসল করছি। স্কুল-কলেজ জীবনের অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। বাচ্চু, কী আশ্চর্য পরিবর্তন, কলেজে যেসব ছেলে প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা করতো, পাঠ্য পুস্তকের বাইরে নানা ধরনের বই পড়তো, ওছিলো তাদের মধ্যে সেরা। একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলো। রাজনীতির কতো রোমা কর ঘটনা ঘটেছে ওর জীবনে, কিছুই শোনা হলো না। এসব যখন ভাবছি, তখন বাথরুমের দরোজায় থাবা পড়লো। আমার সমস্ত শরীরে সাবান ভর্তি। আবার দরোজায় থাবা পড়লো। দরোজা খুলে দেখলাম রেবেকা দাঁড়িয়ে। আচমকা প্রশ্ন করলো, লোকটা কী করে? কোথায় থাকে?
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম− এখনই এভাবে জিজ্ঞাসা করছো কেনো? ওটাতো পরেও জানতে পারতে। রেবেকার আবদার− আহা বলো না, বলেই গোসল করো। আসছি− একমিনিট বলে আমি দরোজা বন্ধ করলাম।
নাস্তার টেবিলে আজ অনেক খাবার− কলা, আপেল, আঙুর। মাঝে মাঝে স্যান্ডউইচ বানায় রেবেকা। আজও বানিয়েছে সারাদিন এসব খাবার তৈরি নিয়েই আছে সে। নতুন নতুন খাবার তৈরি, ঘর পরিষ্কার, ঘর গোছানো, সারাক্ষণ এসব নিয়েই থাকে। মেয়েরা অথবা আমি একটু এলোমেলো করলে সে আক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরে, ক্ষেপে যায়। ঘ্যান ঘ্যান করে। যেখানকার জিনিস সেখানে রাখা হয়নি কেনো। পান থেকে চুন খসতে দেয় না রেবেকা। সব সময় একটা ভয় কাজ করে ওর মনে। এই বুঝি গÐগোল লেগে গেলো। একটা অনিয়ম বুঝি আর একটা অনিয়মকে তরান্বিত করলো। রেবেকা গম্ভীর মুখে আমার প্লেটে স্যান্ডউইচ তুলে দি”িছলো। কোনো কথা বলছিলো না। বললাম, এতো গম্ভীর কেনো? বা”চারা স্কুলে, রোজিনার মা রান্না ঘরে, জ্ঞানত আমি কোনো অন্যায় করিনি।
তখনো কৃত্রিম গম্ভীর রেবেকা। আমি আবার বললাম, বলো কি হলো? এবার রেবেকা মুখ খুললো− এখন তো আর গোসল করছো না, বলো? আ”ছা এই ব্যাপার, বললাম, বা”চু আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একসাথে স্কুল-কলেজে পড়েছি। অনেকদিন, প্রায় বিশ বছর ওর সাথে যোগাযোগ ছিলো না। রেবেকা বললো, ওসব না, আমি জানতে চা”িছলাম ভদ্রলোক কী করেন? কোথায় থাকেন?
‘এখনো কিছু করছে না। ঢাকাতে পার্টনারশিপে ববসা শুরু করেছিলো, মার খেয়েছে। টাকা নিয়ে পালিয়েছে ওর পার্টনার। বছরখানেক হলো চট্টগ্রামে এসেছে, একটা কিছু করার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছে।’
‘আজব ব্যাপার! কিছুই করে না, তো খায় কি?’
‘ওর বউ একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, বললো বেশ কষ্ট করে আছে ওখানে।’
‘প্রথম দিন এসেই এসব কথা বললো, নিশ্চয়ই সে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলো। দেখো সে আবার আসবে।’
‘তুমি কি করে বুঝলে, আবার আসবে?’
‘আমি বুঝতে পারি। শুধু আসবে না, দেখো এসেই বলবে− ভীষণ প্রবলেম, কিছু টাকা ধার দাও। লোকটাকে আমার ভালো লাগেনি। কেমন টাউট টাউট ভাব।’
‘এসব কি বাজে বকছো তুমি! ও আমার স্কুলের বন্ধু, আমরা পাশাপাশি গ্রামের মানুষ, ওকে আমি চিনি ও একজন বিপ্লবী, দেশপ্রেমিক, সবচেয়ে বড়ো কথা ও সৎলোক।’
‘ওসব পুরনো কাসুন্দি, অতীতে কে কি ছিলো ওটা জেনে কী লাভ বলো।’
‘লাভ আছে।’
‘তুমি যাই বলো, তাকে আমার ভালো লাগেনি। বউয়ের ওপর খাচ্ছে। দেখলে না পিরিচের সমস্ত বিস্কুট সাবাড় করে দিলো মুহূর্তে, সিগারেট চেয়ে খেলো।’
‘তাতে কি হয়েছে। ওরা এ রকমই, ছোটোখাটো জিনিস নিয়ে আমাদের মতো খুঁতখুঁত করে না। ওরা প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা করে। বিজনেসে মার খেলে, সমস্যায় পড়লে মানুষ এমন হয়ে যায়।’
‘ওসব বিজনেস-টিজনেস বাজে কথা। তুমি একজন বোকা মানুষ। ওর বিশ বছরের জীবন তোমার কাছে অজ্ঞাত। এখন যা কিছু বলছে তার কতোটুকু সত্যি। ওসব দলের লোকেরা কখনো ভাল হয় না। টাকার কথা যখন তুলেছে তখন হঠাৎ একদিন এসে বলবে− দোস্ত, কিছু টাকা ধার দাও।’
‘কী জানি আমি এসব কিছু ভবিনি।’
আমি জামা-কাপড় পরে অফিসে ছুটলাম। ঠিকাদাররা অপেক্ষা করবে আমার জন্যে।
মাসখানেক পর এক শীতের রাতে হঠাৎ উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে হাজির বা”চু। ওকে বসতে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছো বাচ্চু? বাচ্চু শুষ্ক হাসি হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। আমি বললাম, কি খবর? ব্যবসা-ট্যাবসা ধরতে পারলে কিছু? একটা দীর্ঘশ্বাস চেড়ে বা”চু বললো− মধু, বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়েছি, মিনুর শরীরটা খুব খারাপ। যদি কিছু টাকা ধার দিতে তাহলে খুব উপকার হতো।
আমি চমকে উঠলাম। রেবেকা যা বলেছিলো তাই হলো। সত্যিই টাকা চাইতে এলে বাচ্চু। সত্যিই কি এভাবে মিথ্যে বলে মানুষের কাছে টাকা ধার চায়? বললাম, কতো টাকা? হাজার খানেক হলে চলবে− ও বললো।
আমি বললাম− তুমি বসো, আমি দেখি ভাÐারের অবস্থাটা কি। বেডরুমে গিয়ে আমি স্টিল আলমারিটা খুললাম। টাকা গুণে দেখলাম, যা টাকা আছে, তাতে হাজারখানেক টাকা ওকে ধার দেয়া যেতে পারে। আমার মাস চলে যাবে স্বচছন্দে। টাকা গুণছি আমি। পেছনে ফিরেই দেখি রেবেকা দাঁড়িয়ে। সে বললো− কি ব্যাপার, টাকা কি করছো! বললাম−বা”চুর কিছু টাকার দরকার, ধার হিসাবে চাচ্ছে, দিয়ে দেবে। রেবেকার ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি। সে কটাক্ষ করলো, তোমাকে বলেছিলাম না লোকটা টাউট। এভাবেই প্রথম পরিচয়ে ও বলে বেড়ায় বিজনেসে মার খেয়েছে, দ্বিতীয় দিন এসে এভাবে টাকা নিয়ে যায়। ওর সংসারটা এভাবেই চলে। তুমি এসব বোঝো না, আস্ত বোকা লোক। টাকা দিতে হবে না, বলো সামনের মাসে আসতে। নেশাটেশা করে কিনা আল্লা জানে। বাচ্চু কে টাকা ধার দেয়া উচিত হবে কি হবে না বুঝতে পারলাম না। রেবেকার কথায় দারুণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগলাম। রেবেকাকে বললাম− ওর সামনে গিয়ে কি বলবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। রেবেকা মুখটা আমার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো, বলবে সপ্তাহখানেক আগে একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি, হাতে এখন টাকা নেই, কিছু মনে করো না।
আমি বললাম, সামান্য টাকার জন্যে মিথ্যে কথা বলবো? Ñমিথ্যের বিপরীতে মিথ্যে, এতে অপরাধের কি আছে, রেবেকা বললো।
বাচ্চু ড্রইংরুমে টাকার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমরা ছেলেবেলার বন্ধু, কী করে ওর মুখের ওপর বলি টাকা দিতে পরবো না। আমি ড্রইংরুমে ঢুকতে পারছিলাম না। একটা লজ্জা আমাকে আ”ছন্ন করে ফেললো মুহূর্তে, তবু ঢুকে পড়লাম। বাচ্চু উঠে দাঁড়ালো। একটু হেসে আমি বললাম− বাচ্চু তুমি মাইন্ড করো না, ক’দিন আগে একটা ড্রেসিং টেবিল কিনেছি। হাত একেবারে খালি, কথাটা তোমাকে বলতে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে, বিশ্বাস করো। তুমি বর অন্য কোথাও…।
আমার কথাগুলো শুনে বা”চু একদম চুপসে গেলো। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহুর্তে। মনে হলো আমি যেনো ওর গালে প্রচনড জোরে একটা চড় কষালাম। বাচ্চু বললো− আমার ভুল হয়েছে মধু, কিছু মনে করো না, আসি। বাচ্চু দ্রুত বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
তারপর বাচ্চু আর আসেনি। ব্যস্ততার মধ্যে আমি ভুলে গেছি বা”চুর কথা। বা”চু দ্বিতীয়বার আসার মাসখানেক পর এক বিকালে অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। রিকশাটা আজ ঘুরে যাচ্ছে, ওপাশের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। জামাল খান রোড ধরে রিকশা এগুচ্ছে সামনে। হঠাৎ চোখে পড়লো ফাইভ স্টার সেলুন। ঐ দোকানটার সাইনবোর্ড দেখেই বা”চুর বাসার কথা মনে পড়ে গেলো। রিকশা ছেড়ে দিয়ে সেদিকে হাঁটতে লাগলাম। ভাবলাম মিনু আর বা”চুকে সারপ্রাইজ দেবো।
সেলুনের পাশ দিয়ে একটা আলগা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। পুরনো বিল্ডিং। দরোজার কড়া নাড়তেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বা”চু সাহেব বাসায় আছেন? ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন, বা”চু সাহেব! চিনি না। আমি নতুন এসেছি। নিচের সেলুনে খোঁজ নিন, ওরা বলতে পারবে।
সেলুনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম− ওপরে বা”চু বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন, উনি কোথায় বলতে পারেন? যাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে আর একজনকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ওকে জিজ্ঞাসা করেন।
পাশের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করতেই সে চুলকাটা থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘উনি তো দেশের বাড়ি চলে গেছেন।’
‘হঠাৎ দেশে!’
‘হ্যাঁ, মেহেরপুরে চলে গেছেন। উনার ওয়াইফ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, মারা গেছেন।’
‘বাচ্চুর স্ত্রী মিনু মারা গেছে! কবে, কী করে?’
‘মাসখানেক আগে, বা”চা প্রসব করার সময়, আগে থেকেই অসু¯’ হয়ে পড়েছিলেন।’
সেলুনের লোকটা কেমন একটা ঘৃণার চোখ নিয়ে তাকাচ্ছিলো আমার দিকে!
কোথায় গেলো বাচ্চু ! সেকি মেহেরপুরেই ফিরে গেলো নাকি অন্য কোথাও?
(শেষ)