পৃথিবীর অনেক মসজিদের মধ্যে অন্যতম বিস্ময় হচ্ছে পৃথিবীর বুকে মাটি দিয়ে তৈরি সবচেয়ে বড় মসজিদ। মাটির তৈরি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটির অবস্থান আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে জেনে শহরে। মসজিদটির নাম ‘গ্র্যান্ড মস্ক অব ডিজেনি’।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাটির তৈরি মসজিদ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির বানি নদী তীরের জেনে শহরে মসজিদটি অবস্থিত। স্থাপত্যবিদরা মসজিদটিকে সুদানো-সাহেলিয়ায়ন স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করেন।
মসজিদটি প্রথম নির্মিত হয়েছিল ১৩ শতকের কাছাকাছি সময়ে। তবে বর্তমান নকশায় নির্মিত হয় ১৯০৭ সালে। স্থাপত্য শৈলীর বিবেচনায় এটা সমগ্র আফ্রিকার অন্যতম নিদর্শন। নয়নাভিরাম নকশাখচিত এই মসজিদটিসহ জেনে শহরের ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থানগুলোকে ইউনেস্কো ১৯৮৮ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
জেনে মসজিদটির প্রথম নির্মাণের তারিখ আজো অজানা। তবে ধারণা করা হয় ১২০০ সালে থেকে ১৩৩০সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। সতের শতকে আব্দ আল-সাদি রচিত বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ আল-সুদান এ সর্বপ্রথম মসজিদটির সূত্র পাওয়া যায়।
এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মালির সুলতান কুনবুরু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার প্রাসাদ ভেঙে সেখানে একটি মসজিদ তৈরি করেন। মসজিদের পূর্বদিকে নিজের বসবাসের জন্য একটি প্রাসাদও তৈরি করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার উত্তরাধিকারীরা এই মসজিদের দুটি মিনার এবং চারপাশের দেয়াল নির্মাণ করেন।
জেনে মসজিদ সম্পর্কে ১৯ শতকের প্রথম তিন দশক পর্যন্ত কোনো লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। সে কারণে এর পরিচিতও ছিল অনেক কম। ফরাসি অভিযাত্রী রেনে কেলি ১৮২৯ সালে মালির জেনে শহরে ভ্রমণ করেন। তিনি সফর শেষে জেনে শহরের মাটির তৈরি মসজিদটি সম্পর্কে লিখিত বর্ণনা দেন।
এরপর থেকেই মসজিদটি সুখ্যাতি বাড়তে থাকতে। কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদটি অনেকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯০৭ সালে বর্তমান নকশায় নির্মিত হয়। ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর ২৪ ঘণ্টায় ৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে মসজিদের দক্ষিণ দিকের মিনারের একটি অংশ ধসে পড়ে। এরপর ‘দ্য আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার’ নিজস্ব অর্থায়নে এটির সংস্কার করে।
দি গ্রেট মস্ক অব ডিজেনির দেয়ালগুলো মাটির কাঁচা ইটের তৈরি। নিখুঁতভাবে বালি ও কাদার প্রলেপ দেয়া আছে ইটের উপরে। দেয়ালগুলোর মধ্যে তালগাছের কাঠ দেয়া। যা স্থানীয়ভাবে টরল নামে পরিচিত। তালগাছের কাঠ মসজিদের দেয়ালে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে যাতে মাটির দেয়াল সহজে ধসে না যায়। সংস্কারের সময় কাঠগুলো ভারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ছেলে মেয়ে শিশু সবাই নিজ উদ্যোগে আগ্রহ ভরে মসজিদ মেরামতের কাজে অংশগ্রহণ করে ।
প্রতি বছরই মসজিদটি বর্ষা মৌসুমের আগে সংস্কার করা হয়। বানি নদীর তীরে অবস্থিত এই মসজিদটি পাঁচ হাজার ৬২৬ বর্গ মিটার আয়তনবিশিষ্ট এবং তিন মিটার উঁচু কাঠামোর ওপর নির্মিত। বর্ষাকালে বানি নদীর বন্যার পানি থেকে মসজিদটিকে সুরক্ষা করে এই উঁচু কাঠামো। মসজিদটির মূল প্রবেশ দ্বার উত্তর দিকে অবস্থিত। এর ছয় সেট সিঁড়ি আছে। ১৯৩০ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের ফ্রিজাস শহরে জেনে মসজিদের একটি রেপ্লিকা নির্মিত হয়।
মাটির তৈরি মসজিদটি জেনে শহরের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর রক্ষণাবেক্ষণের অংশ হিসেবে প্রতি বছরই দেয়ালে প্রলেপ দেয়া হয়। জেনে শহর সমগ্র জনবসতি এই কজে অংশ গ্রহণ করে। প্রতি বছর যে দিনটিতে মসজিদের সংস্কার কাজ করা হয় সেদিন অনন্য এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।
এই মসজিদটি মধ্যযুগে আফ্রিকার ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র ছিল। এই মসজিদ থেকেই হাজারো শিক্ষার্থী কোরআন শিক্ষা নিয়েছে।