হজ কেন
রুহুল কুদ্দুস টিটো
হজ মুসলমানদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় ইবাদত, যা এটি করতে শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম এবং তাদের অনুপস্থিতিতে ঘরে তাদের পরিবারকে ভরণপোষণ করতে পারে এমন সকল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানদের তাদের জীবনে অন্তত একবার করতে হয়।
ইসলামি পরিভাষায়, হজ্জ হল সৌদি আরবের পবিত্র শহর মক্কায় অবস্থিত “আল্লাহর ঘর” কাবার উদ্দেশ্যে করা একটি তীর্থযাত্রা। এটি শাহাদাহ (আল্লাহর কাছে শপথ), সালাত (প্রার্থনা), যাকাত (দান) এবং সাওম (রমজানের রোজা) এর পাশাপাশি এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি স্তম্ভ। হজ হলো মুসলিম জনগণের সংহতি এবং সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) কাছে তাদের আত্মসমর্পণের একটি বাহ্যিক প্রকাশ।
হজ্জ ৭ম শতাব্দীর ইসলামের নবি মুহাম্মাদ (স.) জীবনের সাথে জড়িত, তবে মক্কায় তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠানটি ইব্রাহিমের সময় পর্যন্ত হাজার হাজার বছর পুরনো ।
মুহাম্মদ হজের বর্তমান আদর্শটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তবে, কুরআন অনুসারে, হজের মূলসূত্রগুলো ইব্রাহিমের সময় থেকে পাওয়া যায়। ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে, ইব্রাহিমকে আল্লাহ তার স্ত্রী হাজেরা এবং তার শিশুপুত্র ইসমাইলকে প্রাচীন মক্কার মরুভূমিতে একা রেখে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পানির সন্ধানে হাজেরা মরিয়া হয়ে সাতবার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে ছুটে গেলেন কিন্তু কিছুই পাননি। হতাশা নিয়ে ইসমাইলের কাছে ফিরে এসে, তিনি দেখতে পেলেন শিশুটি তার পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে এবং তার পায়ের নীচে একটি জলের ফোয়ারা বের হচ্ছে।
পরবর্তীতে, ইব্রাহিমকে কাবা নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল (যা তিনি ইসমাইলের সহায়তায় সম্পন্ন করেছিলেন) এবং সেখানে তীর্থযাত্রা করার জন্য লোকদের আমন্ত্রণ জানানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কুরআনে এইঘটনাগুলোকে কুরআন ২:১২৪–১২৭ এবং কুরআন ২২:২৭–৩০ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।
হজের সময়, তীর্থযাত্রী বা হাজিগণ লক্ষাধিক মানুষের পদযাত্রায় যোগ দেন, যারা একই সাথে হজের সপ্তাহের জন্য মক্কায় একত্রিত হন এবং একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন: প্রত্যেক ব্যক্তি কাবার (একটি ঘনক আকৃতির ভবন এবং মুসলমানদের জন্য প্রার্থনার জন্য ক্বিবলা) চারপাশে সাতবার ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে হাঁটেন, সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দ্রুত পায়ে হেঁটে যান, তারপর জমজম কূপ থেকে পান করেন, আরাফাত পাহাড়ের ময়দানে গিয়ে অবস্থান করেন, মুজদালিফার ময়দানে একটি রাত কাটান এবং তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করে শয়তানকে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করেন।
একটি পশু কোরবানি করার পরে (যা একটি ভাউচার ব্যবহার করে সম্পন্ন করা যেতে পারে), হজযাত্রীদের তাদের মাথা ন্যাড়া করতে হয় বা চুল ছাঁটাই করতে হয় (পুরুষ হলে) বা তাদের চুলের প্রান্ত ছাঁটাই করতে হয় (মহিলা হলে)। এর পরে ঈদুল আযহার চারদিনব্যাপী বৈশ্বিক উৎসবের উদযাপন শুরু হয়।
ওমরাহ হজ
মুসলমানরা বছরের অন্য সময়ে মক্কায় ওমরাহ (আরবি: عُمرَة) বা “ছোট হজযাত্রা” করতে পারে। তবে, ওমরাহ হজের বিকল্প নয় এবং মুসলিমরা ওমরাহ করার পরেও তাদের জীবদ্দশায় অন্য কোনো সময়ে হজ পালন করতে বাধ্য যদি তাদের তা করার উপায় থাকে।
যখন আমি কাবাঘরকে মানব জাতির জন্য সম্মিলন ও নিরাপত্তা স্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজেরর স্থান বানাও এবং ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, আমার ঘরকে তাওয়াকারী, অবস্থান ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।(সুরা বাকারা,আয়াত:১২৫)
হজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আয়াত
وَاِذۡ جَعَلۡنَا الۡبَیۡتَ مَثَابَۃً لِّلنَّاسِ وَاَمۡنًا ؕ وَاتَّخِذُوۡا مِنۡ مَّقَامِ اِبۡرٰہٖمَ مُصَلًّی ؕ وَعَہِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰہٖمَ وَاِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَہِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَالۡعٰکِفِیۡنَ وَالرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ
এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি কা‘বাগৃহকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম আর বলেছিলাম, ‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর।’ আর ইব্রাহীম ও ইস্মাঈলকে তাওয়াফকারী, ই‘তিকাফকারী, রুক‚‘ ও সিজ্দাকারীদের জন্যে আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম। —আল বাকারা – ১২৫
اِنَّ الصَّفَا وَالۡمَرۡوَۃَ مِنۡ شَعَآئِرِ اللّٰہِ ۚ فَمَنۡ حَجَّ الۡبَیۡتَ اَوِ اعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡہِ اَنۡ یَّطَّوَّفَ بِہِمَا ؕ وَمَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا ۙ فَاِنَّ اللّٰہَ شَاکِرٌ عَلِیۡمٌ
নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহ্ র নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে কেউ কা‘বাগৃহের হজ্জ কিংবা ‘উমরা সম্পন্ন করে এই দুইটির মধ্যে সা‘ঈ করলে তার কোন পাপ নেই আর কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করলে আল্লাহ্ তো পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ। —আল বাকারা – ১৫৮
وَاَتِمُّوا الۡحَجَّ وَالۡعُمۡرَۃَ لِلّٰہِ ؕ فَاِنۡ اُحۡصِرۡتُمۡ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡہَدۡیِ ۚ وَلَا تَحۡلِقُوۡا رُءُوۡسَکُمۡ حَتّٰی یَبۡلُغَ الۡہَدۡیُ مَحِلَّہٗ ؕ فَمَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ بِہٖۤ اَذًی مِّنۡ رَّاۡسِہٖ فَفِدۡیَۃٌ مِّنۡ صِیَامٍ اَوۡ صَدَقَۃٍ اَوۡ نُسُکٍ ۚ فَاِذَاۤ اَمِنۡتُمۡ ٝ فَمَنۡ تَمَتَّعَ بِالۡعُمۡرَۃِ اِلَی الۡحَجِّ فَمَا اسۡتَیۡسَرَ مِنَ الۡہَدۡیِ ۚ فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ ثَلٰثَۃِ اَیَّامٍ فِی الۡحَجِّ وَسَبۡعَۃٍ اِذَا رَجَعۡتُمۡ ؕ تِلۡکَ عَشَرَۃٌ کَامِلَۃٌ ؕ ذٰلِکَ لِمَنۡ لَّمۡ یَکُنۡ اَہۡلُہٗ حَاضِرِی الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَاتَّقُوا اللّٰہَ وَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ٪
তোমরা আল্লাহ্ র উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরা পূর্ণ কর, কিন্তু তোমরা যদি বাধাপ্রাপ্ত হও তবে সহজলভ্য কুরবানী কর। যে পর্যন্ত কুরবানীর পশু এর স্থানে না পৌঁছে তোমরা মস্তক মুণ্ডন কর না। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পীড়িত হয় কিংবা মাথায় ক্লেশ থাকে তবে সিয়াম কিংবা সাদাকা বা কুরবানীর মাধ্যমে এর ফিদ্য়া দিবে। যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি হজ্জের প্রাক্কালে উমরা দিয়ে লাভবান হতে চায় সে সহজলভ্য কুরবানী করবে। কিন্তু যদি কেউ তা না পায় তবে তাকে হজ্জের সময় তিনদিন এবং বাড়ী ফেরার পর সাতদিন-এই পূর্ণ দশদিন সিয়াম পালন করতে হবে। এটা তাদের জন্যে, যাদের পরিজনবর্গ মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়। আল্লাহ্কে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ শাস্তি দানে কঠোর। —আল বাকারা – ১৯৬
اَلۡحَجُّ اَشۡہُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡہِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوۡقَ ۙ وَلَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَمَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡہُ اللّٰہُ ؕؔ وَتَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَاتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ
হজ্জ হয় সুনির্দিষ্ট মাসসমূহে। এরপর যে কেউ এ মাসগুলিতে হজ্জ করা স্থির করে তার জন্যে হজ্জের সময়ে স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু কর আল্লাহ্ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা কর, আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর। —আল বাকারা – ১৯৭
لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ فَاِذَاۤ اَفَضۡتُمۡ مِّنۡ عَرَفٰتٍ فَاذۡکُرُوا اللّٰہَ عِنۡدَ الۡمَشۡعَرِ الۡحَرَامِ ۪ وَاذۡکُرُوۡہُ کَمَا ہَدٰىکُمۡ ۚ وَاِنۡ کُنۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلِہٖ لَمِنَ الضَّآلِّیۡنَ
তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। যখন তোমরা ‘আরাফাত হতে ফিরে আসবে তখন মাশ‘আরুল হারামের নিকট পৌঁছে আল্লাহ্কে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেইভাবে স্মরণ করবে; যদিও ইতিপূর্বে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। —আল বাকারা – ১৯৮
ثُمَّ اَفِیۡضُوۡا مِنۡ حَیۡثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَاسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
এরপর অন্যান্য লোক যেখান হতে ফিরে আসে তোমরাও সে স্থান হতে ফিরে আসবে। আর আল্লাহ্ র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। —আল বাকারা – ১৯৯