বিশ্বব্যাপি তাপমাত্রার রেকর্ড বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই প্রচন্ড গরম চলছে
গত কদিন ধরেই প্রচন্ড গরম চলছে বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে দিনাজপুরে। এছাড়া দুদিন আগে থেকেই তাপপ্রবাহের সতর্কতা দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস, যা অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে পূর্বাভাসে।
বিবিসির প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে অনেকগুলো দেশে এখন বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপ প্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীন ও জাপান পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধের অনেকগুলো দেশে জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই তাপপ্রবাহকে ‘নজিরবিহীন’ বলে আখ্যায়িত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ছবি> বিবিসি বাংলা থেকে সংগৃহিত
‘ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকেই তাপপ্রবাহ’
চলমান তাপপ্রবাহের তিনটি কারণের কথা বলছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। যার একটি ঘূর্ণিঝড় মোখা।
“সাইক্লোন মোখার কারণে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছিল। ফলে ভারত-বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেশি। মোখার সময় এই পুরো বেল্ট ওভারহিটেড হয়ে যায়। এটা একটা কারণ।” বলেন আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম।
তিনি জানান, মোখার প্রভাবে এখনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বিরাজ করছে। আর সে থেকে লু হাওয়া বইছে বাংলাদেশের দিকে।
মি. কালাম মনে করেন বজ্রঝড় কমে যাওয়াও তাপপ্রবাহের একটা কারণ।
“প্রত্যেকবার মে মাসে ১৮ থেকে ২৪ দিন বজ্রঝড় বা কালবৈশাখীর আনাগোনা থাকে। ফলে হিমালয় থেকে সেভেন সিস্টার্স পর্যন্ত তাপমাত্রা কম থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে বজ্রঝড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টিও কম হচ্ছে, মাটি উত্তপ্ত থাকছে।”
তাপপ্রবাহের আরেকটা কারণ হল বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য। যা বাতাসের আর্দ্রতা বাড়াচ্ছে। একইসাথে বাতাসের গতিবেগও এখন অনেক কম বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। ফলে মানুষের কষ্ট আরো বাড়ছে।
বিশ্বব্যাপি তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছিল এ বছরেরই জুন মাসে।
প্রচণ্ড গরমের কারণে অন্যতম গুরুতর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে ইউরোপের দক্ষিণ দিকের ভূমধ্যসাগর-সংলগ্ন এলাকায়। ইউরোপ মহাদেশে এখন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ রেকর্ডের কাছাকাছি উঠে গেছে।
ইতালি জুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। স্পেনে লা পালমা দ্বীপে এক দাবানল সৃষ্টি হওয়ায় কমপক্ষে ৫০০ লোককে নিরাপদ জায়গাং সরিয়ে নিতে হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ায় অগ্নিকান্ডে বাড়িঘর ও গাড়ি পুড়ে গেছে।গ্রীসে শুক্রবার তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি। প্রচণ্ড গরমের কারণে পর্যটনের ভরা মৌসুমে এথেন্সের অন্যতম দর্শনীয় স্থান অ্যাক্রোপলিসের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।
লোকজনকে প্রতিদিন অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে এবং এ্যালকোহল ও কফি এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে – কারণ এগুলোতে দেহে পানির পরিমাণ কমে যায়।
ইউরোপের মহাকাশ সংস্থা বলছে, আগামী সপ্তাহে আরেকটি বড় তাপপ্রবাহ আসবে এবং ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও পোল্যান্ডে পরিস্থিতি চরম আকার নিতে পারে।
উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কোতেও প্রচণ্ড গরমের জন্য সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে।
চীন ও জাপানেরও কিছু অঞ্চলে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে।
গরমে অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেতে…
সূর্যের আলো এড়িয়ে চলা
সকাল ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত রোদের তীব্রতা বেশি থাকে।
এ সময় জরুরি কাজ না থাকলে বাইরে বের না হওয়াটাই ভালো।
ছাতা ব্যবহার
বাইরে বের হলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করা, যাতে সরাসরি রোদের মধ্যে থাকতে না হয়। এ সময় চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপও ব্যবহার করা যেতে পারে।
যারা মাঠেঘাটে কাজ করেন, তারা মাথায় ‘মাথাল’ জাতীয় টুপি ব্যবহার করতে পারবেন, যা তাদের রোদ থেকে রক্ষা করবে।
বেশি করে পানি পান করা
গরমে ঘাম হয়ে শরীর থেকে প্রচুর পরিষ্কার পানি বের হয়ে যায়, তখন ইলেট্রোলাইট ইমব্যালান্স তৈরি হতে পারে। এ কারণে এই সময়টাতে প্রচুর পানি পান করতে হবে।
লবণ মিশিয়ে পানি পান করতে পারলে আরো ভালো। ফলের জুস খাওয়া শরীরের জন্য ভালো, তবে এ জাতীয় জুস খাওয়ার সময় দেখে নিতে হবে সেটি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত পানি দিয়ে তৈরি কিনা। খোলা, পথের পাশের দুষিত পানি বা সরবত এড়িয়ে চলতে হবে।
সূতির কাপড় পরতে হবে
গরমের এই সময়টায় জিন্স বা মোটা কাপড় না পরে সুতির নরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে।
এ ধরণের কাপড়ে অতিরিক্ত ঘাম হবে না এবং শরীর ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করবে।
গরমের সময় কালো বা গাঢ় রঙের কাপড় এগিয়ে সাদা বা হালকা রঙের কাপর পরিধান করা ভালো, কারণ হালকা কাপড় তাপ শোষণ করে কম।
সঠিক জুতা নির্বাচন
গরমের সময় খোলামেলা জুতা পরা উচিত, যাতে পায়ে বাতাস চলাচল করতে পারে।
কাপড় বা সিনথেটিকে বাদ দিয়ে চামড়ার জুতা হলে ভালো, কারণ এতে গরম কম লাগে। সম্ভব হলে মোজা এড়িয়ে চলা যেতে পারে।
ভারী ও ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন
এ জাতীয় খাবার হজম করতে সময় বেশি লাগে। ফলে সেটি শরীরের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে এবং শরীরের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়।
বিশেষ করে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য সেটি আরো বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
খাবারের মেন্যু থেকে গরমের সময় তেলযুক্ত খাবার, মাংস, বিরিয়ানি, ফাস্টফুড ইত্যাদি বাদ দেয়া যেতে পারে। বরং শাকসবজি ও ফলমূল বেশি করে খাওয়া যেতে পারে।
পুরনো বা বাসী খাবার না খাওয়া
গরমে খাবার-দাবার তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
ফলে বাসী খাবার বা আগের দিন রান্না করা খাবার খাওয়ার আগে দেখে নিতে হবে যে, সেটি নষ্ট কিনা। এ জাতীয় খাবার খেলে ডায়রিয়া, পাতলা পায়খানাসহ পেটের অসুখ হতে পারে।
ঘরে পানি ভর্তি বালতি রাখা
এসি না থাকলেও সমস্যা নেই। ঘরের ভেতর ফ্যানের নীচে একটি পানি ভর্তি বালতি রাখুন, যা ঘরকে খানিকটা ঠাণ্ডা করে তুলবে।
প্রতিদিন অবশ্যই গোসল করা
গরমের সময় প্রতিদিন অবশ্যই গোসল করতে হবে, যা শরীর ঠাণ্ডা রাখবে। দিনে একাধিকবার হাত, মুখ, পায়ে পানি দিয়ে ধুতে পারলে ভালো।
বাইরে বের হলে একটি রুমাল ভিজিয়ে সঙ্গে রাখতে হবে, যা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুখ মুছে নেয়া যাবে।
হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা
প্রচণ্ড গরমে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারে।
ফলে মাংসপেশি ব্যথা, দুর্বল লাগা ও প্রচণ্ড পিপাসা হওয়া, দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথাব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলে প্রেশার পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।