মুহাম্মদ স. এর জীবদ্দশায় তিনি জীবিত ছিলেন তবে তাঁদের কখনো দেখা হয়নি
তিনি হলেন উয়াইস আল করনি ছিলেন ইয়েমেনের একজন সুফি ও দার্শনিক। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় তিনি জীবিত ছিলেন তবে তাদের কখনো দেখা হয়নি।
ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী, উয়াইস করনি সিফফিনের যুদ্ধে আলি ইবনে আবি তালিবের পক্ষে লড়াই করে মারা যান। সিরিয়ার রাক্কাহতে তার মাজার ছিল। ২০১৩ সালে চরমপন্থি ইসলামি গোষ্ঠী এটি গুঁড়িয়ে দেয়।তাঁর সম্মানে তুরস্কের সির্ত প্রদেশের বায়কানে একটি মাজার নির্মাণ করা হয়েছে।
উয়াইস করনির পিতা আবদুল্লাহ একজন মুসলিম ছিলেন এবং উয়াইসের অল্পবয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় উয়ায়েস করনি মুহাম্মদ স. এর সমসাময়িক হলেও তাদের কখনও দেখা হয়নি কারণ উয়াইস ধর্ম সাধনায় নিয়ত রত থাকতেন এবং তার অন্ধ মায়ের দেখাশোনা করতেন। আলি ইবনে আবি তালিবের এবং উমর ইবনে আল-খাত্তাবের সাথে সাক্ষাতের পর তার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং উৎসুক জনতা তাকে এক নজর দেখার জন্য তার আবাসস্থলে গমন করতে থাকে। এতে উয়াইস করনির ধর্ম সাধনায় ব্যঘাত সৃষ্টি হয় এবং নির্বিঘ্ন সাধনার জন্য উয়াইস করনের উদ্দেশ্যে কুফা ত্যাগ করেন। তার সময়ে তাকে আলির একজন অনুসারী বলে ধরা হত। তিনি উট পালন করে অর্থ উপার্জন করতেন।
উয়াইস করনীর মর্যাদা
উসাইর ইবনু জাবির (রা:) বলেন, ইয়ামানে বসবাসকারীদের পক্ষ থেকে ওমর (রা:)-এর নিকট সাহায্যকারী দল আসলে তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করতেন, ‘তোমাদের মাঝে কি উয়াইস ইবনু আমির আছে’? অবশেষে (একদিন) উয়াইস (রহঃ) এসে গেলেন। তাকে ওমর প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি উয়াইস ইবনু আমির’? সে বলল, হ্যাঁ। ওমর (রা:) আবার বললেন, ‘মুরাদ’ সম্প্রদায়ের উপগোত্র ‘কারনের’লোক? তিনি বললেন, হ্যাঁ । তিনি বললেন, ‘আপনার কি কুষ্ঠরোগ হয়েছিল, আপনি তা হতে সুস্থ হয়েছেন এবং মাত্র এক দিরহাম পরিমাণ স্থান বাকী আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘আপনার মা জীবিত আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
ওমর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘ইয়ামানের সহযোগী দলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির নামক এক লোক তোমাদের নিকট আসবে। সে ‘মুরাদ’জাতির উপজাতি ‘কারনের’লোক। তার কুষ্ঠরোগ হবে এবং তা হ’তে সে মুক্তি পাবে, শুধুমাত্র এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া। তার মা বেঁচে আছে, সে তার মায়ের খুবই অনুগত। সে (আল্লাহ্র উপর ভরসা করে) কোন কিছুর শপথ করলে তা আল্লাহ্ তা’আলা পূরণ করে দেন। তুমি যদি তাকে দিয়ে তোমার গুনাহ মাফের জন্য দোআ করাবার সুযোগ পাও, তাহলে তাই করবে।
ওমর (রা:) বলেন, ‘কাজেই আমার অপরাধ ক্ষমার জন্য আপনি দোয়া করুন। তখন তিনি (উয়াইস) ওমরের অপরাধের ক্ষমা চেয়ে দোয়া করলেন। ওমর (রা:) তাকে বললেন, ‘আপনি কোথায় যেতে চান? তিনি বললেন, ‘কূফায়। তিনি (ওমর) বলেন, ‘আমি সেখানকার গভর্নরকে আপনার (সাহায্যের) জন্য লিখে দেই? তিনি বললেন, ‘আমার নিকট গরীব-মিসকিনদের মাঝে বসবাস করাই বেশী পছন্দনীয়। পরের বছর কূফার এক নেতৃস্থানীয় লোক হজ্জে এলো। তার সাথে ওমরের দেখা হলে তিনি উয়াইস সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করলেন। সে বলল, ‘আমি তাকে এরকম অবস্থায় দেখে এসেছি যে, তার ঘরটা অত্যন্ত জীর্ণ অবস্থায় আছে এবং তার জীবন-যাপনের উপকরণসমূহ খুবই নগণ্য।
ওমর (রা:) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘উয়াইস ইবনু আমির নামক এক লোক ইয়ামানের সাহায্যকারী দলের সাথে তোমাদের নিকট আসবে। সে ‘মুরাদ’জাতির উপজাতি ‘কারন’বংশীয় লোক। তার কুষ্ঠ রোগ হবে এবং তা থেকে সে মুক্তি পাবে, শুধুমাত্র এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া। তার মা বেঁচে আছে এবং সে তার মায়ের খুবই অনুগত। সে (আল্লাহ্র উপর ভরসা করে) কোন কিছুর শপথ করলে তা আল্লাহ্ পূরণ করে দেন। তুমি যদি তোমার গুনাহ মাফের জন্য তাকে দিয়ে দোআ করানোর সুযোগ পাও, তাহলে তাই করবে। লোকটি ফিরে এসে উয়াইসের নিকট গিয়ে বলল, ‘আমার অপরাধ ক্ষমার জন্য আপনি দোআ করুন।
তিনি (উয়াইস) বললেন, ‘এইমাত্র আপনি মঙ্গলময় সফর (হজ্জ) থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন; বরং আপনিই আমার অপরাধ ক্ষমার জন্য দোআ করুন। তিনি বললেন, ‘আপনি কি ওমরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সে বলল, হ্যাঁ। তার জন্য উয়াইস দোআ করলেন। উয়াইসের মর্যাদা সম্পর্কে লোকেরা সচেতন হলে সেখান থেকে উয়াইস অন্য স্থানে চলে গেলেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রা:)-এর নিকট কূফার অধিবাসীরা একটি সাহায্যকারী দল পাঠায়। দলের এক লোক উয়াইসকে বিদ্রূপ করত। ওমর (রা:) বললেন, ‘এখানে ‘কারন’বংশীয় কেউ আছে কি? ঐ ব্যক্তিটি উঠে আসলে ওমর (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ইয়ামান থেকে উয়াইস নামে এক লোক তোমার নিকট আসবে। সে তার মাকে ইয়ামানে একা রেখে আসবে। তার কুষ্ঠরোগ হবে। সে আল্লাহ্র নিকট দোআ করবে, আল্লাহ্ তার রোগমুক্তি দান করবেন, শুধুমাত্র এক দীনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া। তোমাদের মধ্যে যে কেউ তার দেখা পাবে, তাকে দিয়ে সে যেন তার গুনাহ মাফের জন্য দোআ করায়। ওমর (রা:) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘পরবর্তীদের (তাবেঈ) মধ্যে উয়াইস নামে এক সৎ লোক হবে। তার মা বেঁচে আছে। তার শরীরে কুষ্ঠের চিহ্ন থাকবে। তার নিকট গিয়ে নিজের গুনাহ মাফের জন্য তাকে দিয়ে প্রার্থনা করাও। [মুসলিম হা/২৫৪২, ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’অধ্যায়, অনুচেছদ-৫৫]
উয়াইসি তরিকার সাতটি- ভিত্তি বা মূলনীতি
উয়ায়েছি তরিকার সাতটি- ভিত্তি বা মূলনীতি (সংক্ষেপিত) ১) এতায়েতঃ (ایتایات) এর শাব্দিক অর্থ তাবেদারী করা বা অনুসরণ করা তরিকতের ভাষায় আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ নিষেধ মেনে সর্বতোভাবে আল্লাহর জ্ঞানে দাখিল হওয়াকে এতায়েত বলে।
২) খেলওয়াতঃ (الخلوات) এর অর্থ নির্জনতা। চক্ষু ও অন্তরের নির্জনতা। আল্লাহ ব্যতিরেকে চোখে ও অন্তরে অন্য কিছু না দেখা আল্লাহর একত্বে নিমজ্জিত থাকা।
৩) খামুশীঃ (سکوت) জিব্বাহ ও অন্তরের নীরবতাকে খামোশি বলা হয়। আল্লাহর ধ্যানে নিজেকে মশগুল রাখা। সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত থাকা। আল্লাহর সাথে সংযুক্ত থাকলে জিহ্বা ও অন্তরের নীরবতা পালন সম্ভব।
৪) নযর-বর-কদমঃ (نزار بار قدم) অর্থ পায়ের উপর নজর রাখা। সর্বদা নিচু হয়ে চলা। আল্লাহর স্মরণ ব্যতীত অন্য কোনো দিকে না তাকানো। অন্য কোনো কিছুর প্রতি আসক্তি না থাকা। বিনয় প্রকাশ করা।
৫) হশ-হর-দমঃ (هاش هار دوم) ফার্সি ভাষায় শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে দমের প্রতি সজাগ থাকা। প্রতি দমে আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।
৬) জহর নূশীঃ (خوردن سم) এর বাংলা তরজমা হচ্ছে বিষ পান করা। তরিকতের জ্ঞানে রাগ গোস্বা কে হজম করা। ধৈর্য ধারণ করার শক্তি অর্জন করাকে বিষ পান করার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
৭) পরদাহ পুশীঃ ( پرده پوشی) গোপন রাখা। অন্যের দোষ খুঁজে না বেরিয়ে গোপন রাখা কে পর্দা করা বলা হয়েছে।