মক্কা ও মদিনা অন্য ধর্মের লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার কারন
রুহুল কুদ্দুস টিটো
কাবা ছিল মানবজাতির জন্য প্রথম উপাসনার ঘর, এবং এটি আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম এবং ইসমাইল দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, মানবজাতির জন্য নির্ধারিত প্রথম ঘর (ইবাদত) ছিল বাক্কায় (মক্কা), (যা) বরকতময় এবং মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক।
“আদিম বাড়ি”, অথবা al-Baytu l-Ḥarām (البيت الحرام “পবিত্র বাড়ি”, একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত, যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারামের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটিকে কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।ইসলাম ধর্ম মতে কাবা কে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে মান্য করা হয়।
হজের গুরুত্বপূর্ণ রোকন তাওয়াফ > তাওয়াফ হল ঘড়ির কাটার বিপরীতমুখী হয়ে কাবা ঘরের চারপাশে ৭ বার প্রদক্ষিণ করা। কাবার চারদিকে একত্রে ঘুরন্ত মুসলমানেরা এক আল্লাহ্র নামে একাত্মতা প্রকাশ করার জ্বলন্ত উদাহরণ । তাওয়াফ শুরুর স্থান পবিত্র কাবা শরিফের যে কোনায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত । তাওয়াফ শুরুর পূর্বে হাজারে আসওয়াদে চুমু দেয়ার নিয়ম।
মানবজাতিকে শয়তান কিভাবে ধোকা দেয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল তৎকালীন আরব বাসী। হজরত ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ আসমানে তুলে নেয়ার পরে ৬১০ বছর কোন নবী না থাকায় আরবরা উলঙ্গ হয়ে কাবা ঘরের তাওয়াফ করত, এটাই ছিল সে সময়কার হজ্ব আর আরাফাতের ময়দানে গিয়ে আল্লাহর স্মরনের পরিবর্তে তাদের পুর্বপুরুষের গুনকীর্তন করত। নবিীজির আগমনের পর রাসুল (সাঃ) এর সময়ে মক্কায় অমুসলিমরা বাস করত। তবে মসজিদুল হারামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের পরে আল্লাহ যখন সুরা তাওবা নাযিল করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাবে কাফের মুশরিকদের জন্য ঘোষণা দিয়ে দেন তারা যেন আর কাবার নিকট না আসে।কারণ আল্লাহ তায়ালা তাদের উলঙ্গ তাওয়াফ পছন্দ করেন না।
হে ইমান আনয়নকারীগণ, নিশ্চয়ই মুশরিকরা (অমুসলিম/যে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ সাব্যস্ত করে) অপবিত্র,অতএব, এ বছরের (মাক্কা বিজয়ের বছর) পর তারা যেন মাসজিদ আল হারমের (কা’বা) নিকটবর্তী না হয়,যদি তোমরা(মু’মিনরা) দারিদ্রের ভয় কর, তবে অতি শীঘ্রই আল্লাহ তোমাদের অভাবমুক্ত করবেন তার অনুগ্রহের দ্বারা, যদি তিনি চান, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়।[আত তাওবাহ, ২৮]
কেন সূরা কাফিরুন
সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৬।
হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, ওলীদ ইবনে মুগীরা, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে আবুদল মোত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খলফ প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকজন একবার রসূলুল্লাহ্ – এর কাছে এসে বললঃ আসুন, আমরা পরস্পরের মধ্যে এই শান্তি চুক্তি করি যে, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন এবং এক বছর আমরা আপনার উপাস্যের এবাদত করব।
তাবরানীর রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, কাফেররা প্রথমে পারস্পরিক শান্তির স্বার্থে রসূলুল্লাহ্ – এর সামনে এই প্রস্তাব রাখল যে, আমরা আপনাকে বিপুল পরিমাণে ধনৈশ্বর্য দেব, ফলে আপনি মক্কার সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। আপনি যে মহিলাকে ইচ্ছা বিবাহ করতে পারবেন। বিনিময়ে শুধু আমাদের উপাস্যদেরকে মন্দ বলবেন না। যদি আপনি এটাও মেনে না নেন, তবে এক বছর আমরা আপনার উপাস্যের এবাদত করব এবং এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের এবাদত করবেন।
আবু সালেহ্-এর রেওয়ায়েতে হযরত ইবনে আব্বাস বলেনঃ মক্কার কাফেররা পারস্পরিক শান্তির লহ্ম্যে এই প্রস্তাব দিল যে, আপনি আমাদের কোন প্রতিমার গায়ে কেবল হাত লাগিয়ে দিন, আমরা আপনাকে সত্য বলব। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিবরাঈল আ. সূরা কাফিরূন নিয়ে আগমন করলেন। এতে কাফেরদের ক্রিয়াকর্মের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং আল্লাহ্ তা’আলার অকৃতিম এবাদতের আদেশ আছে।
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা কাফিরুন এবং সূরা ইখলাস ফজরের সুন্নতে এবং মাগরিব পরবর্তী সুন্নতে অধিক পরিমাণে পাঠ করতেন, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “সূরা ‘কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন’ কুরআনের এক চতুর্থাংশ”।
সূরা কাফিরূন
কুল ইয়াআইয়ুহাল কা-ফিরূন।লাআ‘বুদুমা-তা‘বুদূন।ওয়ালাআনতুম ‘আ-বিদূনা মাআ‘বুদ।ওয়ালাআনা ‘আ-বিদুম মা-‘আবাত্তুম,ওয়ালাআনতুম ‘আ-বিদূনা মাআ‘বুদ।লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।
সূরা কাফিরুন অর্থ> বলুন, হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত কর। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা কর। তোমরা এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে।
সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এটির বিষয় এবং ঘটনা পরিষ্কার ভাবে স্থান, সময় ও পরিস্থিতিকে বুঝাতে সক্ষম রয়েছে। এটি ইসলামের উত্থানের মুহূর্তে অবতীর্ণ হয়েছে যখন সংখ্যায় অবিশ্বাসীদের তুলনায় মুসলিমরা সংখ্যালঘু এবং মুহাম্মদ প্রবল চাপের মধ্যে ছিলেন। অবিশ্বাসীরা তাকে তাদের ধর্মের (মূর্তিপূজা ও ইসলাম পরিপন্থী কার্যক্রম) পথে ডাকার চেষ্টা করলে তিনি কোনপ্রকার দ্বন্দ্ব ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের হতাশার মাঝে ফেলে দেন।
এখানে শুধুমাত্র ঐ সমস্ত কাফেরদেরকে বিশেষভাবে বুঝানো হয়েছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ জানতেন যে, তাদের মৃত্যু কুফর ও শিরকের অবস্থাতেই ঘটবে। কেননা, এ সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার পর কিছু সংখ্যক মুশরিক ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং তারা আল্লাহর ইবাদত করেছিল।
কাফেররা মহানবী -এর কাছে যখন (নিরপেক্ষ সন্ধি) প্রস্তাব রাখল যে, এক বছর আমরা তোমার উপাস্যের ইবাদত করব এবং এক বছর তুমি আমাদের উপাস্যের ইবাদত করবে। প্রতি উত্তর থাকে, এটা কখনই সম্ভব নয় যে, আমি তাওহীদের পথ পরিত্যাগ করে শিরকের পথ অবলম্বন করে নেব; যেমন তোমরা চাচ্ছ। আর যদি আল্লাহ তোমাদের ভাগ্যে হিদায়াত না লিখে থাকেন, তাহলে তোমরাও তাওহীদ ও আল্লাহর উপাসনা থেকে বঞ্চিতই থাকবে।
যদি তোমরা তোমাদের দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট থাক এবং তা ত্যাগ করতে রাজী না হও, তাহলে আমিও নিজের দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট, তা কেন ত্যাগ করব? (لَناَ أَعْمَالُناَ وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ) অর্থাৎ, আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য। (আল ক্বাস্বাস ৫৫ আয়াত) (তাছাড়া তোমাদের কর্ম ভ্রষ্ট এবং আমার কর্ম শ্রেষ্ঠ। আর অন্যায়ের সাথে কোন আপোস নেই।
ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন,নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে ওসিয়ত করেন, মুশরিকদেরকে জাযিরাতুল আরব (আরবীয় উপদ্বীপ) থেকে বের করে দাও।[মিশকাত]
আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বশেষ যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন তা হলো,“জাযিরাতুল আরবে কখনো দুই ধর্ম থাকতে পারবে না”[মিশকাত]
সহীহ মুসলিমে আবু যুবাইরের সনদে বর্ণিত,তিনি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেনঃ আমি অবশ্যই ইহুদি নাসারাদেরকে জাযিরাতুল আরব (আরবীয় উপদ্বীপ) থেকে বের করে দিব। এমনকি এখানে মুসলিম ছাড়া কাউকে রাখব না। [সাহিহ মুসলিম]
কেয়ামতের আগে যখন এক চক্ষুবিশিষ্ট দাজ্জাল বাহির হবে তখন সে সারা পৃথিবীতে বিচরন করতে পারবে কিন্তু পবিত্র নগরী মক্কা আর মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। এই দুই জায়গা আল্লাহ ফেরেশতা দিয়ে পাহাড়া বসাবেন এই জন্য সে ঢুকতে পারবে না।
পবিত্র মক্কা নগরী রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্মস্থান।এখানে ইসলামের অনেক পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ন নিদর্শনাবলী রয়েছে।এখানে রয়েছে পবিত্র কাবা ঘর যা মুসলমানদের কিবলা(যে দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা হয়)।ইসলাম ধর্ম মতে কাবা কে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করা হয়।কাবাকে ঘিরে রয়েছে মসজিদুল হারাম।
এই নগরীর গুরুত্ব এতটাই বেশি যে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই নগরীর শপথ করেছেন।পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
“শপথ আঞ্জীর (ডুমুর) ও যয়তুনের,
এবং সিনাই প্রান্তরস্থ তূর পর্বতের,
এবং এই নিরাপদ নগরীর(মক্কা)।
আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে।” -সূরা ত্বীন (আয়াত ১-৪)
রাসুল (সাঃ) এর সময়ে মক্কায় অমুসলিমরা বাস করত।তবে মসজিদুল হারামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
“হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল-হারামের নিকট না আসে।…” -সূরা আত তাওবাহ (আয়াত ২৮)
*এ বছর দ্বারা মক্কা বিজয়ের বছরের কথা বলা হয়েছে।
মদিনার জন্য নিষিদ্ধ .কাবাঘরের চারপাশের প্রায় ২ বর্গমাইল এলাকা হারাম হিসেবে সাব্যস্ত। পরবর্তীতে শাসকরা সতর্কতা হিসেবে তার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে মক্কা গেইট পর্যন্ত নিয়ে যান।আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজে মদিনা শরীফকেও হারাম হিসেবে সাব্যস্ত করেন। যার ফলে মদিনার মধ্যেও চারদিক থেকে নির্দিষ্ট একটি জায়গার পরে অমুসলিমদের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ।
পবিত্র নগরীর পবিত্রতা রক্ষার্থে সৌদি সরকার সম্পূর্ন নগরীকে অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে।