মশিউর রহমান যাদু মিয়া ।। ছাত্র জীবনে তিনি অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু।।তেভাগা আন্দোলনের সময় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য বিতর্কিত হন তিনি
রুহল কুদ্দুস টিটো
মশিউর রহমান যিনি যাদু মিয়া নামে পরিচিত,তিনি মাওলানা ভাসানীর শিষ্য ছিলেন এবং ১৯৭৬-এ তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি হন। ছাত্র জীবনে তিনি অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। তবে তেভাগা আন্দোলনের সময় তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তিনি এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অতঃপর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয় এবং ১৯৭৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এ রাজনৈতিক দলের একজন জাতীয় নেতা হিসাবে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন।
১৯২৪ খ্রীস্টাব্দের ৯ জুলাই তৎকালীন রংপুর জেলা (বর্তমানে নীলফামারী জেলার) ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওসমান গণি ও মা আলহাজ্ব আবিউন নেছা, তৎকালীন সমাজে অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই সময়ই তিনি বার্মা গমন ও যুদ্ধাহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ৪০ দশকের দুর্ভিক্ষের সময় রংপুরের চরাঞ্চলে যখন প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি জনগনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তার সেবার স্বীকৃতি স্বরূপই তার নামানুসারে একটি চরের নাম করন করা হয় ‘যাদুর চর’।
১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় সহিংসতার বিরুদ্ধে ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির লক্ষ্যে হত্যাযজ্ঞের বিভৎসতার ছবি তুলে যাদু মিয়া একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। ৪০-এর শেষের দিকে তিনি ইয়াং ম্যান এসোসিয়েশন অব পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান ছিলেন।
রংপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অনারারী সেক্রেটারী ও ১৯৫৪- ৫৮ পর্যন্ত রংপুর জেলা কনজুমারস কো-অপারেটিভ সোসাইটি‘র বৃহত্তর রংপুরের নির্বাচিত সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ৫০-দশকের শেষ দিকে রংপুর জেলা বোর্ডের কনিষ্ঠতম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পর পর দুইবার প্রতিদ্বন্দীতায় নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন শেষে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের উদ্দ্যেগে অনুষ্ঠিত যুব উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ঐ একই সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আহ্বানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে অনুষ্ঠানে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের উপ-নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর চীনে পাকিস্তানি সরকারী সফরে প্রতিনিধি দলের নেতা মওলানা ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনিই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য তাকে গ্রেফতার করে।
৬৬ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আহ্বানে গণআন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল সেখানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। ৬০-এর দশকের শেষের দিকে মশিউর রহমান যাদু মিয়া ন্যাপ-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ও আইয়ুব বিরোধী ১১-দফা আন্দোলনে তিনি জাতীয় পরিষদের ভিতরে ও বাইরে সোচ্চার দাবী উপস্থাপন করেন এবং আন্দোলনের পক্ষে মওলানা ভাসানীর আহ্বানে জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৯ সালে টোবাটেকসিং এ কৃষক সম্মেলনে ইয়াহিয়া খানকে গাদ্দার বলার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসন মূলক বিচারের মাধ্যমে সাত বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
১৯৭১-এ তিনি প্রথমে ভারতে যান এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য বিতর্কিত হন।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং তখন তিনি তিন বছর দুই মাস কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৭৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে তদানিন্তন সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু, মাত্র তিন মাসের মাথায় ১৯৭৪ সালের জুন মাসে আবারো তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৫ সালে নভেম্বর মাসে তিনি কারা মুক্ত হন।
১৯৭৬ সালে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের প্রস্তুতি ও সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেই সময়টিতেই তিনি জিয়াউর রহমানের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদায় সিনিয়র মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রগতিশীল-দেশপ্রেমিক-গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তির সমন্বয়ে প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও পরবর্তীকালে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে ন্যাপরে কার্যক্রম স্থগিত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তিনি ন্যাপ তথা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একাংশ নিয়ে এ দলে যোগ দেন। এই দলটি ই কিছুদিন পরে আরো কিছু দলের সাথে এক জোট হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (সংক্ষেপেঃ বিএনপি) গঠন করে। বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (সংক্ষেপেঃ জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। যাদু মিয়া এ দলের আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
মশিউর রহমান জন্ম জুলাই ৯, ১৯২৪ – মার্চ ১২, ১৯৭৯ সালে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৭৯-এ এক দুঘর্টনায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি গুরুতর রূপে আহত হন এবং বেশ কয়েকদিন অজ্ঞান অবস্থায় ঢাকার পি, জি, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১২ মার্চ মারা যান। সবোর্ত্তম চিকিৎসার স্বার্থে তার জন্য ভারত এবং পাকিস্তান থেকে শ্রেষ্ঠ শল্য চিকিৎসকদের আনা হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া