সাম্প্রতিককালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত সিরিজ বৈঠকে দুই মিত্রের মধ্যে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিদ্যমান মতপার্থক্য কমেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারমূলক অবস্থানকে সমর্থন করতে ভারত সম্মত হয়েছে। ভারতের দ্য ফেডারেল ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক।
খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত দুটি সাধারণ নির্বাচনের (২০১৪ এবং ২০১৯) আগে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র তিক্ত কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিল। যেখানে দিল্লি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে মরিয়া ছিল এবং ওয়াশিংটন যে কোনো মূল্যে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য চাপ দিচ্ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্বরত এক জন শীর্ষ ভারতীয় কূটনীতিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয়ের জন্য চীন একটি বড় উদ্বেগ। দুই দেশ ক্রমবর্ধমানভাবে একটি সর্বাত্মক কৌশলগত অংশীদারিত্বে আবদ্ধ, যে কারণে বাংলাদেশের মতো আঞ্চলিক ইস্যুতে মতপার্থক্যের ঝুঁকি নিতে দিল্লি বা ওয়াশিংটন কেউই সমর্থ হবে না। তিনি বলেন যে, গত কয়েক মাস ধরে, উভয় দেশই বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে তাদের মতপার্থক্যগুলো কমাতে চেষ্টা করেছে। বেশির ভাগ আলোচনা হয়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র মতো ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা দিল্লি এবং ঢাকা সফর করেছেন। এটা কিছুটা ফল দিয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল নিয়ে কাজ করা ঊর্ধ্বতন ভারতীয় কর্মকর্তারা দ্য ফেডারেলকে বলেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ একটি কার্যকরী গণতন্ত্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে এবং বিকশিত হতে পারে। যেটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে যুক্ত।
তারা বলেছে, দিল্লি ওয়াশিংটনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্ভব। সেটা উগ্র ইসলামপন্থী এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল বিরোধী দলগুলোর রাজপথে সহিংস প্রতিবাদের মাধ্যমে, বর্তমান সরকারের পতনের মাধ্যমে নয়।
ভারতের এক জন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, আমরা সরকার কর্তৃক মৌলবাদী উপাদানগুলোকে পদ্ধতিগতভাবে উৎসাহিত করায় খুবই বিরক্ত। সুপ্রিম কোর্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের মামলায় শেখ হাসিনা সরকারের ধীরে চলো মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। এক জন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এটি ইচ্ছাকৃত বলে মনে হচ্ছে। কারণ সরকার একটি বার্তা পাঠাতে পারে যে জামায়াতের বিরুদ্ধে একটি রায় সহিংসতার উসকানি দিতে পারে এবং তাই শুনানি বিলম্বিত করা উচিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়া আরেকটি ইসলামপন্থী শাসনের ভার বহন করতে সমর্থ হবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, তবে আমরা ঢাকায় ইসলামপন্থী শাসনকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না।
খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা যখন জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লিতে যাবেন তখন তাকে দুটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে। এক, একটি ক্ষমতাশালী নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে। দুই, আওয়ামী লীগকে অবশ্যই দলীয় পদ থেকে চীনপন্থি এবং ইসলামপন্থী নেতাদের বাদ দিতে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য জনপ্রিয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে। এক জন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে রক্ষা/সমর্থন করতে পারি না’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র সার্বিকভাবে সম্মত হয়েছে যে, বাংলাদেশকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে এবং একটি একদলীয় রাষ্ট্রে যাতে পরিণত না হয় তা নিশ্চিত করতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা উভয়েই বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও বেসামরিক-সামরিক উভয় স্তরে গভীর চীনা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয়ই একই অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ যেন একদলীয় রাষ্ট্রের চীনা মডেলে না যায় তাও নিশ্চিত করতে চায়।
মতপার্থক্যের একমাত্র ক্ষেত্রটি হলো— যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু ভারত নিশ্চিত করতে চায় যে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকবে।