বিচারপতি আবু মুহাম্মদ সায়েমকে সরানোর অন্যতম কারণ ছিল সায়েম যেকোনো সময় নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এই ভয় থেকে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জিয়া।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘বিএনপি সময়-অসময়’ বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বইটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন।
রুহুল কুদ্দুস টিটো
রাতভর ক্ষমতা ছিনতাইয়ের এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।
বাধ্য হয়ে তিনি কাগজটি হাতে নিলেন- যেখানে লেখা ছিল- ‘আমি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে অক্ষম। কাজেই আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনিত করছি। এবং তার কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করছি।’ সই ও তারিখ ২১ এপ্রিল ১৯৭৭।
বিচারপতি আবু মুহাম্মদ সায়েমকে সরানোর অন্যতম কারণ ছিল সায়েম যেকোনো সময় নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এই ভয় থেকে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জিয়া।
জিয়াউর রহমান কী আসলেই যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন?
১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। বাংলার সবুজ জমিনকে রক্তে লাল করে দিতে তাদের কোনো চিন্তা করতে হয়নি। নির্বিচারে তারা হত্যা করেছে অগণিত মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ, পাকিস্তানি হানাদারদের বুলেট থেকে কেউ রক্ষা পায়নি।
তবে জিয়াউর রহমান কী আসলেই যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন? সময় সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর শক্তি বাড়াতে যত ধরনের আয়োজন দরকার, সবই করছিলেন ইয়াহিয়া খান। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন শ্রীলঙ্কার ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক ফ্লাইট আসতো। জাহাজে অস্ত্র ও সৈন্য আসছে, সোয়াতে আসছে। সেই সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে বাঙালি সৈনিকরা।
তখন সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব দেয়া হয় জিয়াকে। সেই অস্ত্র দিয়েই বাঙালিদের হত্যার পরিকল্পনা ছিল।‘এরমধ্যে ইপিআরের উইং কমান্ডার মেজর রফিক বীর উত্তম (তখন তিনি ক্যাপ্টেন) বিদ্রোহ করেন। চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকায় পাহাড়ের ওপর একটি কাঠের গেস্ট হাউসে অবস্থান করছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের ২৫ বা ২৬ মার্চ রাতে সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাওয়ার কথা ছিল। তখন পথে পথে বেরিকেড দেয়া হয়েছিল। জিয়া এই বেরিকেড ভেঙেই সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে যেতে চেয়েছিলেন। তখন কর্নেল অলি একটি গাড়িতে এসে মেজর জিয়াকে বলেন যে, ঢাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।’
সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও সময় সংবাদকে এমন তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, ২৫ মার্চে জিয়া পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ সরঞ্জাম খালাস করতে গিয়েছিলেন। মেজর রফিক সেদিনও পার্লামেন্টে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে মেজর রফিক বলেছেন, সেদিন জিয়াউর রহমান সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যাচ্ছিলেন একটি জিপে করে।
“তার এই জিপে করে যাওয়ার কথা যখন তারা জানতে পারলেন, তখন রফিক তাকে থামালেন। শুধু রফিকই না, তার যে সেকেন্ড অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন অলি। তিনি জিয়াকে পিস্তল ধরে হুমকি দেন যে আর এক পা এগোলো আপনাকে আমি গুলি করতে বাধ্য হবো। জিয়া তখন বলেছিলেন, আমার তো ওপর থেকে নির্দেশ আছে, ব্রিগেডিয়ার জানজুয়ার নির্দেশ আছে, আমাকে যেতেই হবে, না গেলে তো আমাকে কোর্ট মার্শালে পড়তে হবে,” যোগ করেন তিনি।
বিচারপতি মানিক বলেন, তখন পিস্তল ধরে অলি তাকে বলেছিলেন, আপনি এক পা সামনে গেলে আমি গুলি করবো। তারপরে যখন বাঙালি সেনারা বাধা দিল, তিনি বুঝতে পারলেন যে আরেক পা সামনে বাড়ালে তার মৃত্যু হবে, তখন তিনি বাধ্য হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিকে চলে গেলেন।পরে তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে একটি ব্রিগেড তৈরি করা হলে জুনের শেষ দিকে মেজর জিয়াকে এর কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশে মেজর জিয়ার প্রথম অক্ষর নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর এই ব্রিগেডের নাম রাখা হয় জেড ফোর্স। জিয়াকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদায়ন করা হয়।
ক্ষুব্ধ ছিলেন জিয়া
১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয় সফিউল্লাহকে। আর জিয়াউর রহমানকে করা হয় ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। সেনাপ্রধান না হতে পেরে জিয়ার মনে ক্ষোভ ছিল। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
তার অনুগত একজন লে. কর্নেল আবু তাহের। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী, তাহের একবার তার কছে এসে বলেছিলেন, ‘স্যার, এতদিন তো চিফ থাকলেন, এখন এ পদটা জিয়াউর রহমানের জন্য ছেড়ে দেন।’ জবাবে সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘ইউ আর ডাউন ক্যাটাগোরাইজড; এখনই সিএমএইচে গিয়ে সসম্মানে মেডিকেল বোর্ড আউট হয়ে যাও।’
লে. কর্নেল হামিদের ভাষ্য অনুযায়ী, সফিউল্লাহ ও খালেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘অনুগত’। তখন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সফিউল্লাহর পর খালেদই সেনাপ্রধান হবেন। জিয়াকে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে করা হতো। বিভিন্ন সময় উল্টাপাল্টা কর্মকাণ্ড করার কারণে তার বিষয়ে সবার নেতিবাচক ধারণা ছিল। এ সময়ে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে বার্লিনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে যায়। এটা জেনে তখনকার কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশীদ উদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে তদবির করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি পেতে তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন জিয়া। একবার রেগে গিয়ে কর্নেল হামিদকে জিয়া বলেন, ‘শেখকে ওই ব্যাটারাই (সফিউল্লাহ, খালেদ) আমার বিরুদ্ধে খেপিয়েছে’।
১৯৭৫ সালের ২৫ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। জিয়া তাকে প্রায়ই বলতেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি; সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের পদটি তারই পাওয়া উচিত ছিল।
অধ্যাপক নূরুল ইসলামের ভাষ্যানুযায়ী, ‘পদাতিক বাহিনীর কাঠামোবিন্যাস নিয়ে একদিন আমি, প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হক, জেনারেল সফিউল্লাহ ও জিয়ার মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। সে সময় খবর পাই, সফিউল্লাহকে তিন বছরের মেয়াদশেষে আরও তিন বছরের জন্য সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু। এটি জানার পর জিয়াউর রহমান আমার অফিসে এসে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে বলেন। প্রতিরক্ষাসচিব মুজিবুল হককেও বিষয়টি জানান তিনি।
‘‘আমি জিয়াউর রহমানকে দুই-একদিন অপেক্ষা করতে বলি এবং বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জানাই। সেদিন বঙ্গবন্ধু খুবই রেগে গিয়ে বলেন, ‘তুমি এখনই তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। তুমি জানো না, জিয়া অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী।’’
নূরুল ইসলাম লিখেছেন, ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের দুই দিন আগে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে আমাকে অবহিত করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করি। বঙ্গবন্ধুও মনে হয়, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের কাছ থেকে আগে কিছু আভাস পেয়েছিলেন। ডিজিএফআইয়ের প্রধানও আমার সঙ্গে আলোচনা করে সফিউল্লাহকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, কেন নেয়া হয়নি তা এখনো আমার অজানা। এর দুই-দিন পরেই ঘটে এ দেশের ইতিহাসের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।
এরপরই রাজনীতিতে দেখা দেয় পালাবদলের হাওয়া। অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ একটি ঘোষণা দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন। এতে বলা হয়, ১৫ আগস্ট ভোরবেলা থেকে সামরিক আইন কার্যকর হয়েছে।
ভাগ্য খুললো জিয়ার
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাবাহিনীতে পরিবর্তনের প্রথম ধাক্কা লাগে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ওপর। ২৪ আগস্ট তাকে সরিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সেনাপ্রধান হওয়ার খবর পেয়ে তিনি কেবল খুশিই হননি, মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের সিগন্যাল মেসের গ্রাউন্ডে অফিসার ও জওয়ানদের জড়ো করে তিনি চিৎকার করে জানিয়ে দেন, ‘আজ থেকে আমি চিফ অব স্টাফ’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলেন জিয়াউর রহমান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর সকাল ৬টায় কর্নেল রশিদ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় যান। শাফায়াতের কাছে সব শুনে বিচলিত না হয়ে জিয়া বলেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। গেট ইয়োর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’ অর্থাৎ (রাষ্ট্রপতি মারা গেছেন, তাতে কী হয়েছে, উপরাষ্ট্রপতি আছেন। সৈন্যদের প্রস্তুত রাখো, সংবিধান অনুসারে চলো।)
৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি শপথ নেন। এরপরে বেতার ও টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ন্যূনতম সময়ের মধ্যে অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’
এরপর জিয়া, ওসমানী, খলিল, তাওয়াব, এমএইচ খান, মাহবুব আলম চাষী ও আবু তাহের সভায় বসেন। সেখানে দেশের শাসন কাঠামো নিয়ে কথা হয়। সেখানে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও তাকে উপপ্রধান আইন প্রশাসক হিসেবে থেকে যেতে হলো।
নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধীদের
পঁচাত্তরের নভেম্বরে শুধু শাসকই বদল হয়নি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তিতেও পরিবর্তন চলে আসে। পঁচাত্তরের ৩১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমের নামে সামরিক আইনের দ্বিতীয় ফরমানের তৃতীয় সংশোধনী আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বলা ছিল, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনো অপরাধে দণ্ডিত হলে তিনি সংসদে নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশে এ উপধারাটি বাতিল হওয়ায় দালাল আইনে অভিযুক্ত একাত্তরের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগীদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকল না।
নির্বাচন দেয়া হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসবে সেই আশঙ্কা থেকে বিচারপতি সায়েমকে দিয়ে নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেন জিয়া। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর বেতার ও টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে সংসদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা জারির এক সপ্তাহের মধ্যেই জিয়া প্রেসিডেন্টের ডানা ছেঁটে দেন।
বঙ্গভবনের নাটক
জিয়া উপলব্ধি করেন, বিচারপতি সায়েম একাধারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকলেও তার জন্য এটি বিপজ্জনক হতে পারে। রাষ্ট্রপতি সায়েম নির্বাচন দিলে জিয়ার আকাঙ্ক্ষা মাটিতে মিশে যাবে। তখন জিয়াকে সরিয়ে অন্য কাউকে সায়েম সেনাপ্রধান নিয়োগ দিতে পারে বলেও কথা শোনা যাচ্ছিল।
এরপর ২৮ নভেম্বর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিয়ে বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বলেন জিয়া। কিন্তু তাতে রাজি হননি সায়েম। পরে রাত একটায় রণভঙ্গ দিলেন সায়েম। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করেন তিনি। এরমধ্য দিয়ে মধ্যরাতে আরেকটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বরে জারি হলো সামরিক আইনের তৃতীয় ফরমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) সময় সংবাদকে বলেন, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাত্রিবেলায় দলবল ও সেনাবাহিনীর লোকজন নিয়ে হাজির হন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতিকে একেবারে কিছু না জানিয়ে তারা বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। এরপর বিচারপতি সায়েমকে বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। এই ক্ষমতা আমার কাছে অর্পণ করবেন। সেই মর্মে আপনি আদেশনামায় সই করে দেন। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন সায়েম। এরপর অনেক বাগবিতণ্ডা ঘটে, এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা জিয়ার হাতে অর্পণ করতে বাধ্য হন সায়েম।
তিনি বলেন, যেভাবে সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে, তাতে মনে হবে, পিস্তল ঠেকিয়েই সায়েমের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন জিয়া। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইতে এসব তথ্য আছে।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, সন্ধ্যা থেকে রাত একটা পর্যন্ত বাগবিতণ্ডা চলে। ক্ষমতা জিয়াউর রহমানের কাছে হস্তান্তর করতে অনিচ্ছুক ছিলেন সায়েম। কিন্তু অনেক চাপাচাপির পর রাত ১টায় বিচারপতি আবদুস সাত্তারের অনুরোধে তিনি জিয়ার কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেন।
সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় জিয়া
দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন জিয়া সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করান। মোশতাককে গ্রেফতারের বিষয়টি রাষ্ট্রপতি সায়েম জানতেন না। তাকে না জানিয়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতিকে কেন গ্রেফতার করা হলো, সায়েমের এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার, এটা ঘটে গেছে। প্লিজ, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবেন না।’
এরমধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যারা জিয়ার জন্য অস্বস্তি তৈরি করতে চান, তাদের চুপ হয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়া হয়। সায়েম নামেমাত্র রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। এরপর তাকে পুরোপুরি ছাঁটাই করে দিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেন সায়েম। রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ পান জিয়া।
জিয়াউর রহমান একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
জিয়াউর রহমান তার কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন- এ নিয়ে অসন্তুষ্টি গোপন রাখেননি বিচারপতি সায়েম। তিনি লিখেছেন, “কীভাবে সেনাপ্রধান (মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান) একটি স্থায়ী সার্ভিসের অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে স্থল, নৌ ও বিমান- তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেকটির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এ সব পদে জেনারেল ইয়াহিয়া বহাল ছিলেন বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তি ও বিজয় না হওয়া পর্যন্ত।”
সূত্র: বিএনপির সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমেদ; বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি, বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম।