মোদী-হাসিনার বৈঠক
ছবির উৎস,NARENDRA MODI/X ছবি:শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বৈঠক
জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসেবে দিল্লিতে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাগতিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শুক্রবার সন্ধ্যায় দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর বাসভবনে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা ধরে চলেছে ওই বৈঠক।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের একটা পর্যায়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত আলোচনাও হয়েছে।
বৈঠকের ঠিক পর পরই প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজের এক্স (আগেকার টুইটার) অ্যাকাউন্টে বাংলায় লেখেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক।”
তিনি আরও জানান, “আমাদের আলোচনায় কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।”
রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও সে সময় উপস্থিত ছিলেন।
পরারাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে জানান, ‘আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা’র বিষয়টি বৈঠকে খুবই গুরুত্ব পেয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের ইস্যু যেটা, সেটা হল আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। আমরা বারবার এই কথাটা বলছি, ভারতও একই কথা বলছে।”

ছবির উৎস,NARENDRA MODI/Xছবি:দিল্লিতে নিজের বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী
ভারত থেকে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অনুরোধ রাখতেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা অনুরোধ জানিয়েছেন বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়েও বৈঠকে ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আদানপ্রদানের লক্ষ্যে এবং রুপি ও টাকায় বাণিজ্যিক লেনদেনের পথ প্রশস্ত করতে বৈঠকে তিনটি ‘মউ’ বা সমঝোতাপত্রও স্বাক্ষরিত হয়েছে – যেগুলোর কথা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল।
বৈঠকের পর ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পদস্থ সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, দুই নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে অত্যন্ত ‘আন্তরিক, খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে’।
ওই বৈঠকে আরও একবার ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার ‘পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও মৈত্রীরই প্রতিফলন ঘটেছে’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGESছবি:বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন
আর আজকের এই বৈঠক হল এমন একটা সময়ে যখন বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের মাত্র তিন বা সাড়ে তিন মাস বাকি।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থনকে যেহেতু খুব জোরালো একটা ফ্যাক্টর বলে মনে করা হয়, তাই সে দেশে নির্বাচনের ঠিক আগে দুজনের এই বৈঠকের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্যও ছিল অপরিসীম।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (পলিটিক্যাল স্টেবিলিটি) রক্ষায় ভারতের দৃঢ় সমর্থন ও সাহায্যের অঙ্গীকার অক্ষুণ্ণ থাকবে – ভারত বৈঠকে এই আশ্বাস দিয়েছে বলে বিবিসি জানতে পারছে।

ছবির উৎস,PTIছবি:দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস নৈশভোজের এক ফাঁকে নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা। ২৩শে অগাস্ট
বিশেষত মাত্র দু’সপ্তাহ আগে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যেহেতু দু’জনেই উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনও বৈঠক হতে পারেনি – তাই দিল্লিতে এই বৈঠকের একটা আলাদা গুরুত্বও ছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিবিসিকে বলছিলেন, “ব্রিকসে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা গিয়েছিলেন আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার আমন্ত্রণে।”
“আর দিল্লিতে তিনি আসছেন প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিশেষ আমন্ত্রণে – ফলে জি-টোয়েন্টি নিয়ে আমাদের যতই ব্যস্ততা থাকুক দুই নেতার মধ্যে এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটা আমাদের করতেই হত।”

ছবির উৎস,MEA INDIAছবি:শুক্রবার দিল্লি বিমানবন্দরে নামার পর প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। পাশে তাঁর বোন শেখ রেহানা
তিনি আরও জানান, সন্ধ্যাবেলা তিনি একে একে মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রভিন্দ জুগনাথ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তিনটি আলাদা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
“এই বৈঠকগুলো এই তিনটি দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কর পর্যালোচনা এবং উন্নয়নমূলক সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলার সুযোগ এনে দেবে”, মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
জি-টোয়েন্টির মূল বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই তিনি যেভাবে তিনটি নির্দিষ্ট দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলাদা করে নিজের সাত নম্বর লোককল্যাণ মার্গের বাসভবনে বৈঠক করলেন, সেটাকেও পর্যবেক্ষকরা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক ইদানীংকালে কতটা ঘনিষ্ঠ, সে কথা সুবিদিত। আন্তর্জাতিক জোট কোয়াডেরও সদস্য উভয়েই।

ছবির উৎস,GETTY IMAGESছবি:জি-টোয়েন্টিতে অতিথি দেশগুলোকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ভারত
যুক্তরাষ্ট্র ও মরিশাসের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গেও একই দিনে বৈঠকের একটি কূটনৈতিক, রাজনৈতিক বা কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) গুরুত্ব রয়েছে।
জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের পক্ষে যিনি কোঅর্ডিনেটর বা প্রধান সমন্বয়কারীর ভূমিকায় আছেন, সেই হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও এদিন মনে করিয়ে দিয়েছেন, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশকেই কিন্তু ভারত জি-টোয়েন্টিতে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
জি-টোয়েন্টির সভাস্থলে দাঁড়িয়েই ভারতের এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব (ও ঢাকায় নিযুক্ত প্রাক্তন হাই কমিশনার) সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবেই বাংলাদেশকে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এটা খেয়াল করাটা জরুরি।”

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবি:২০২২র সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে মোদী-হাসিনা বৈঠকের পর
বস্তুত জি-টোয়েন্টিতে দু’ডজনেরও বেশি সদস্য ও আমন্ত্রিত দেশের নেতাদের উপস্থিতির মধ্যেও ঘরের পাশের বাংলাদেশকে স্বাগতিক দেশ ভারত যে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে, এটা বোঝানোর জন্য কোনও চেষ্টাই বাদ রাখা হয়নি।
ভারত ও বাংলাদেশের দুই নেতার মধ্যে মুখোমুখি বা ভার্চুয়ালি যে কত ঘন ঘন দেখা হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচীও এদিন বিকেলের দিকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে সরকার পাঠিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর মোদীর আস্থাভাজন বলে পরিচিত, রেল প্রতিমন্ত্রী ও গুজরাটের সুরাট থেকে নির্বাচিত এমপি দর্শনা বিক্রম জারদোশকে। সঙ্গে ছিলেন দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ডেস্কের যুগ্ম সচিব স্মিতা পন্থও।
এছাড়া ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান ও দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তারাও প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে স্বাগত জানাতে টারম্যাকে উপস্থিত ছিলেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশের জন্য আমেরিকা তাদের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে একটা শীতলতা দেখা যাচ্ছে
দিল্লিতে তিন দিনের এই সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদী ছাড়াও তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস), নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ টিনুবু, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো অ্যাঞ্জেল ফার্নান্ডেজ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইওল এবং সংযুক্ত আর আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া যেহেতু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারাও একই সময়ে দিল্লিতে থাকছেন, অবধারিতভাবে বাংলাদেশের দিক থেকে চেষ্টা হবে অনানুষ্ঠানিক স্তরে হলেও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনেরও।
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সরকারের জন্য এই প্রতিটি বৈঠকেরই গুরুত্ব রয়েছে, আর এর জন্য ভারতকে ধন্যবাদও জানাচ্ছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা।