বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের যেমন নাড়ির সম্পর্ক, তেমনি শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রেরও আত্মার সম্পর্ক
রুহুল কুদ্দুস টিটো
শিক্ষক মানেই শ্রদ্ধার পাত্র, গুরুজন, অভিভাবক। মানুষ গড়ার কারিগর। বড় কথা তিনি একজন আদর্শবান মানুষ। বাবা-মা সন্তান জন্ম দিতে পারেন। কিন্তু ছেলেমেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের যেমন নাড়ির সম্পর্ক, তেমনি শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রেরও আত্মার সম্পর্ক।এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পৃথিবীতে যত সম্পর্ক আছে এর মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক একটু ভিন্ন। এর মধ্যে নিহিত থাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও শাসন। একজন ছাত্রের ভালো লেখাপড়ার পেছনে তার অভিভাবকের ও শিক্ষকের গুরুত্ব সমান। তাদের সঙ্গে সম্পর্কটাও গভীর হওয়া প্রয়োজন। এক জন আদর্শ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অভিভাবকের ভূমিকায় কাজ করেন। সঠিক পরামর্শ দিয়ে জীবন গঠনে ভূমিকা রাখেন।
বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষকরা ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় পিতা বা মাতাতুল্য। সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই বিশেষ কার্যকর। তবে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে।
শিক্ষকরা ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় পিতা বা মাতাতুল্য
একজন ছাত্রের দুর্দিনে ছায়ার মতো পাশে দাঁড়ান একজন শিক্ষক।
১৯৬৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়ে, তখন ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ সদস্যরা ছাত্রদের ওপর গুলি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তখন এগিয়ে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা স্যার। তিনি ছাত্রদের গুলি না করার জন্য অনুরোধ করেন। ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এর পর কোনো গুলি ছাত্রের গায়ে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’-
এক পর্যায়ে ড. শামসুজ্জোহা স্যারকেই গুলি করে পুলিশ। আর এভাবেই নিজের জীবন দিয়ে ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির স্হাপন করে গেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের প্রতি ড. শামসুজ্জোহা স্যারের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা শুধু ছাত্র সমাজ নয়, আপামর জনতার হূদয়ে চিরঅম্লান হয়ে আছে।
আদর্শ ছাত্র
মনোজ সরকারের একটি লেখায় পড়ে ছিলাম জেলা পর্যায়ের মস্ত বড় এক কর্মকর্তা একদিন বাজারে যাওয়ার সময় রাস্তা দিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে আসা শতচ্ছিন্ন ধুতি ও ফতুয়া পরা এক কোমর বেঁকে যাওয়া এক বৃদ্ধকে দেখে তিনি পালানোর উপক্রম করলেন; এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
বৃদ্ধটি সামনে আসতেই চারদিকে সব মানুষকে অবাক করে দিয়ে সেই জেলা পর্যায়ের বড় কর্তা, যার কাছে বড় বড় সব কলেজের অধ্যক্ষরা ধর্না দেন- তিনিই পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন আশপাশের সব মানুষ; কিন্তু বৃদ্ধটির চোখে কিংবা কথায় কোনো ভাবান্তর দেখতে পাইনি- যেন এমনটিই হওয়ার ছিল। বৃদ্ধটি শুধু ভাঙা ভাঙা জানতে চাইলেন- কে তুমি বাবা?
আমার সেই বন্ধুর বড়কর্তা কাকা বললেন- আমি অমুক। আমি আপনার কাছ থেকে ‘প্রথম শিখতে শিখেছি’। কিভাবে ‘অ’ লিখতে হয়; বলতে হয়, চলতে হয় সব আপনারই দান। আপনিই আমার ‘প্রথম গুরু’। স্মিতহাস্যে বৃদ্ধটি শুধু বললেন- শিক্ষাটি বিফলে যায়নি। ‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’। আর এটাই হবে আমার ‘গুরুদক্ষিণা’। ওই বৃদ্ধের অসহায় অবস্থা দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুর সেই কাকা; কিন্তু তিনি অতি সম্মানের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
‘শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বন্ধনে মজবুত হওয়া প্রয়োজন। একজন আদর্শ শিক্ষক তার ছাত্রের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করেন। তিনি গুরু, পিতৃতুল্য এই অনুভূতি একজন ছাত্রের ভেতরে থাকা দরকার। এই সম্পর্ক যেখানে দৃঢ়, সেখানেই শিক্ষা তথা সমাজের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। কোনো নিয়ম এ সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’-শুভেন্দু পুরকায়স্থ ভারতের একজন সরকারী কর্মকর্তা
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী জন ডিইউ বলেছেন, ‘একজন শিক্ষক হলেন চালক এবং পথপ্রদর্শক। তিনি গাড়ি চালিয়ে যাবেন, যে গাড়ির চালিকাশক্তির উৎস হলো শিক্ষার্থীরা।’
ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সুন্দর এবং নিবীড় সম্পর্ক থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, একজন ছাত্রকে শিক্ষক শুধু একাডেমিক পাঠদানই করেন না, বরং বাস্তবজীবনে অনেক দিক নির্দেশনাও দিয়ে থাকেন। আবহমান কাল থেকেই ছাত্র-শিক্ষকদের এমন নিবিড় সম্পর্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুঝা যায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আসলে কাঙ্খীত অবস্থানে নেই।
অনেক শিক্ষকই ক্লাসে ঠিকভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনের জন্য জোরাজোরি করেন। প্রাইভেট টিউশন না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কম দেন, ক্লাসে করেন মানসিক অত্যাচার। এই অবস্থায় একজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্ক কখনোই ভালো হতে পারে না। কাজেই ছাত্র-শিক্ষক ভালো সম্পর্ক তৈরিতে সবচেয়ে জরুরি শিক্ষকের আচরণ।
পাবলিক কিংবা প্রাইভেট অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে শিক্ষকদের হাতে ইনকোর্স, প্রাকটিক্যাল নম্বর থাকে, কখনো শাস্তিস্বরূপ শিক্ষার্থীদের নম্বর কম দেওয়া হয়। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষক আছেন যাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে, টেস্ট পরীক্ষাতে ফেল করিয়ে দেয়া হয়। যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ তারা হয়তো এমন দুর্ভোগের মুখোমুখি বেশি হয়। পক্ষান্তরে, কিছু ছাত্রছাত্রী আছে, যারা সারাক্ষণ আড্ডা এবং অনলালাইনে সময় কাটায়, ঠিকমত লেখাপড়া করে না, তাদের ফেল করিয়ে দিলে আবার শিক্ষকদের উপর চড়াও হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা শিক্ষা কিংবা গবেষণার চেয়ে সমসাময়িক বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখান। শিক্ষার চেয়ে নিজেদের স্বার্থে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষকরা। ফলে শিক্ষার মান ধসে পড়ছে। এই ভয়াবহ অবস্থাটা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কেও ফেলছে বিরূপ প্রভাব। নিজেদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে গ্রুপিং এবং অন্যের মতকে সহ্য না করার প্রতিযোগিতা।
এখান থেকে বের হতে হবে আমাদের বের হতে হবে গড়তে হবে সুসম্পর্ক। শিক্ষক-ছাত্র সুসম্পর্ক ছাড়া জ্ঞানার্জন বিতরণও অসম্ভব। একজন শিক্ষকই শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জোগায়, স্বপ্ন দেখায়।ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক হাজার বছর ধরে চলে আসছে। শুধু শিক্ষা কিংবা জ্ঞানার্জন নয়, একজন ছাত্রের দুর্দিনে ছায়ার মতো পাশে দাঁড়ান একজন শিক্ষক। আমাদের সংস্কৃতিতে শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে রয়েছে এক আশ্চর্য সেতুবন্ধন। যে বন্ধন কেবল পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের ওপর গড়ে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এক অদ্ভূতরকম শক্ত গাঁথুনির।
প্রকৃত শিক্ষাদানের কাজটি হয় ছাত্র-শিক্ষকের মধ্য দিয়ে। ছাত্ররা এই প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখে, অর্জন করতে শিখে সাফল্যের। একজন শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক যত বেশি অটুট থাকবে শিক্ষার গুরুত্বতে ছাত্ররা তত বেশি আগ্রহ পাবে। সম্মান, শ্রদ্ধা, শাসন- অনুরাগ মিলিয়ে তৈরি হয় ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক। একজন সন্তান এবং পিতার সম্পর্ক যেমন বন্ধুসুলভ হয় ঠিক তেমনি ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কও বন্ধুসুলভ হওয়া প্রয়োজন। কেননা ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের পিতার সমতুল্য মনে করেন। একজন শিক্ষক ছাত্রদের শুধু শিক্ষাই দেন না পাশাপাশি নৈতিকতাবোধ, মূল্যবোধ এবং আদর্শ মানুষ হতেও শেখায়। সুতরাং ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ হওয়া প্রয়োজন। তবেই জাতি সাফল্যের শিখরে পৌছাবে।
ছাত্র-শিক্ষক সবাই যদি নিয়ম-কানুন ও নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে তাহলে, আমরা আবারও সেই সোনালি দিনের আলোয় আলোকিত হবো, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।