রাজনীতির ইতিহাসে সব সম্পর্কই , সময়ের প্রয়োজনে ।। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করেছে ।। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিশ্বরাজনীতির পরাশক্তিগুলোর অবস্থান বেশ স্পষ্ট ।। ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে দূরত্ব
রুহুল কুদ্দুস টিটো
রাজনীতির ইতিহাসে সব সম্পর্কই , সময়ের প্রয়োজনে
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সমগ্র দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মূলত সংঘাতটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানকে অনেক দেশ সমর্থন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, তুরস্ক, ইরান, শ্রীলংকা, সৌদি আরব। জর্ডান, তুরস্ক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফ্রান্স সে সময় পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে বিমান সহায়তা দিয়েছিল।
১৯৭১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। সোভিয়েত কে ঘায়েল করার জন্য কমিউনিস্ট পিকিং এর সাথে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী ছিল ওয়াশিংটন। যেহেতু ইসলামাবাদ – পিকিং এর সম্পর্ক ছিল অনেক জোরদার, সেহেতু ওয়াশিংটনও ইসলামাবাদের পাশে ছিল, যাতে ইসলামাবাদের মাধ্যমে ওয়াশিংটন – পিকিং এর সম্পর্ক মজবুত করা যায়।
বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে বাংলাদেশ ও ভারতে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত সরকারকে প্রতিরক্ষা চুক্তির গোপন ধারা সক্রিয় করার অনুরোধ করেছিলেন। রাশিয়া জরুরিভাবে বঙ্গোপসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন পাঠিয়েছিল, যা বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিন নেতৃত্বের আগ্রহ এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে রাশিয়া-ভারত ও আমেরিকা-ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। ফলে বেঁচে যায় পৃথিবী, বেঁচে যায় বাংলাদেশ।
কূটনীতিতে কিসিঞ্জার কখনো কখনো স্ববিরোধী ভূমিকাও পালন করেছেন। তিনি ভারতকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ হলে তাদের কোনো লাভ নেই। সেখানে বামপন্থীরা জয়ী হলে ভারতেও প্রবেশ করবে।’ চীনকে বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব বাড়তে দেওয়া হবে না।’ আবার পাকিস্তানকে বলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমেরিকার আপত্তি নেই। (আফসান চৌধুরী: বাংলাদেশ ১৯৭১, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭)
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক: ৯০ দশকের শুরুতে বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পটপরিবর্তন হয়েছে। ৯/১১’র আক্রমণের পর বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সরে এসে অনেকটা নিরাপত্তার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের আবির্ভাব চীনের উত্থান এবং চীনের পাশাপাশি আরও কিছু আঞ্চলিক শক্তি যেমন ভারত, ব্রাজিল এ ধরনের শক্তি এবং রাশিয়াও নতুন করে আরও শক্তি অর্জন করে। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি নতুন অভিজ্ঞতা তৈরি হয় এবং বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের যে জোট এবং জোট হিসেবে তাদের যে একটা শক্তিশালী অবস্থান ছিল সেই জায়গাতে একটা টানাপোড়েন শুরু হতে থাকে।
নব্বইয়ের দশক পার হয়ে ২০০০-এর দশকের শেষ দিকে তেখা গেল এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে, যার মূলে চীন এবং ভারতের অর্থনীতিতে একটা বড় ভূমিকা এবং এর পাশাপাশি বাংলাদেশসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটা নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে এ দেশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের গভীর ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ হলো, এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র।
বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিশ্বরাজনীতির পরাশক্তিগুলোর অবস্থান বেশ স্পষ্ট
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলো বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারে ওপর চাপ অব্যাহত রাখার নীতি নিয়ে চলেছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে তারা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সেখানে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ভিন্ন। এই দেশ দুটি বিভিন্ন সময়ে ও নানাভাবে আওয়ামী লীগ সরকারে প্রতি তাদের সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করে যাচ্ছে। পশ্চিমের তৎপরতাকে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। তাদের পাল্টা বক্তব্য হচ্ছে, কোনো দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারা হস্তক্ষেপ করে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচন, গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো এই দেশ দুটিতেই উপেক্ষিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। অন্য কোনো দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের মাথাব্যথা থাকার কথাও নয়।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের মধ্যে বিরোধী দলের সদস্যও রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমে ডেইলি স্টারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেওয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করব না। কাউকে ভিসা না দেওয়াসহ যেকোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য।
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাদানে দায়ী এবং তাতে সহযোগিতাকারী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে’ এই নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে সমর্থন’ দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসার ব্যাপারে যে ‘নতুন ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে, তার লক্ষ্য বিষয়ে কোনো রাখঢাক করা হয়নি, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের একটি বিশেষ ধারা [২১২ (এ) (৩) ] অনুযায়ী এই নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের এই ধারার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।
এর জন্য সরকারের আলাদা করে কোনো ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অতীতে কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘোষণা দিয়েছে। এই বছরের ১৫ মে নাইজেরিয়ার নির্বাচনের ব্যাপারে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে উগান্ডার নির্বাচনের পরে ওই দেশের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই একই ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ব্যাপারে এই ধরনের ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে অভূতপূর্ব বলে মনে করার কারণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক কারণে কোনো দেশের কাছ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ মোকাবিলা করতে হয়নি।
অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঘটনার পরে। নাইজেরিয়া ও উগান্ডার ক্ষেত্রে নির্বাচন হওয়ার পরে এসব দেশের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নীতি ঘোষণা করা হলো সম্ভাব্য নির্বাচনের অন্তত সাত মাস আগে। যার অর্থ হচ্ছে এই যে নির্বাচনের আগেই যদি কোনো পক্ষ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে, তবে তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা নিতে দ্বিধান্বিত হবে না।
ডোনাল্ড লু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ সরকারকে এই বিষয়ে অবহিত করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে ৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফর করছিলেন এবং ৪ মে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নবম অংশীদারত্ব সংলাপ। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলে ডোনাল্ড লু ছিলেন।
পতাকাবিহীন গাড়িতে পিটার হাস কি বোঝাতে চেয়েছেন
১৯ মে ২০২৩ পত্রিকার সংবাদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বাড়তি সুবিধা বাতিল করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় দেশীয় সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে ঢাকা-ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টির। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নাকচ করে বলা হচ্ছে দেশগুলো চাইলে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে এ সুবিধা পেতে পারে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ আগে থেকেই ঢাকার নাগালের বাইরে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃদেশীয় সফরে মনে করা হয়েছিলো এ দূরত্ব কিছুটা হলেও কমে আসবে। কিন্তু বিষয়টি হয়তো তার বিপরীতই হয়েছে। অন্তত কূটনীতিকদের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত সেটাই বলছে। আবার অনেকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান মানে কোবরা সাপের লেজে পা দেয়া। যদি এটা হয় তাহলে যে কোন সময় ছোবল খেতে হতে পারে।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের বিষয়টি খোলামেলা ভাবেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না’।
বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা তথা স্থায়ী পুলিশি এসকর্ট আচমকা প্রত্যাহারের পর এই প্রথম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো দাওয়াতে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
বাংলাদেশের স্থানীয় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজ কাম কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন তিনি। অন্য সহকর্মীদের মতো যথাসময়েই মার্কিন দূত অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। তবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সরা অ্যাম্বাসেডরস কারে নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আসেন পতাকাহীন গাড়িতে।
যদিও তিনি তার জন্য নির্ধারিত অ্যাম্বাসেডরস কার-১ ই ব্যবহার করছিলেন। গাড়ির সামনে বা পেছনে ছিল না পুলিশ বা দূতাবাসের নিজস্ব কোনো প্রটোকল ব্যবস্থা। তবে রাষ্ট্রদূতকে বহনকারী গাড়ির সামনের সিটে ছিলেন কেবলমাত্র তার গানম্যান। দায়িত্বশীল কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ক্লোজ ডোর ওই ব্রিফিংয়ের পুরোটা সময় উপস্থিত এবং বেশ মনোযোগী ছিলেন পিটার হাস।
তিনি ব্রিফিংয়ে কোনো প্রশ্ন দূরে থাক, মুখে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! এমনকি লাঞ্চের সময়ও নয়। অন্য দূতরা অবশ্য মধ্যাহ্নভোজে পরিবেশিত মৌসুমী ফল আমের উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এতোদিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশ ঢাকায় তাদের কূটনীতিক বিশেষ করে মিশন প্রধানদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে আনসার বাহিনীর একটি চৌকষ দলের সেবা পেতেন। যারা মূলত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতো। এখন থেকে আর সেটি বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি এখনো দূতাবাসগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। তবে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।
ঢাকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি মামুলী হলেও প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর এসকর্ট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত করে। স্পস্টতই এখানে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে দূরত্ব দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় সেটি আগামী নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তারা।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ি যে কোনো কূটনীতিকের নিরাপত্তার বিষয়টি স্বাগতিক দেশকেই নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
রাজনীতির ময়দানেও বিষয়টি তুমুল ঝড় তুলেছে। ইতোমধ্যে সরকার বিরোধীরা এ বিষয়টিকে সামনে এনে বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটলো। সরকার যখন কোনো কিছুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাগে আনতে পারছে না তখনই এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার যে হুমকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেটি নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। নির্বাচনের আট মাস আগেই আমেরিকা কেন এ ধরণের হুঁশিয়ারি দিল? কেউ কেউ একটু এগিয়ে এমন প্রশ্নও করছেন যে এর পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্খাই কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আরো কোন গভীর ‘কৌশলগত’ হিসেব-নিকেশও আছে
বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটা বেশ কঠোর একটা সিদ্ধান্ত, এবং এখানে একটা খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন এখন দেখবে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেখানে কী ঘটে।
মি. কুগেলম্যান বলছেন, তার মনে হচ্ছে যে জো বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র প্রসারের এজেন্ডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হচ্ছে।
তার কথায়, “বাইডেন প্রশাসন একটা মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা জোরালোভাবে প্রয়োগ করছে।”
“বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিল – কিন্তু তখন যুক্তরাষ্ট্র এরকম কোন ভূমিকাই নেয়নি। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি মূল্যবোধ-ভিত্তিক ছিল না। কিন্তু বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি মূল্যবোধ-ভিত্তিক এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তারা অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে রেখেছে।”
ড. আনোয়ার বলছেন, নতুন ভিসা নীতিকে এ প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করাটাই সবচেয়ে সঠিক হবে।
তার কথা হচ্ছে, “বাইডেন সরকার যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে মনে করতো – তাহলে নিশ্চয়ই ডেমোক্রেসি সামিটে ঢাকা আমন্ত্রিত হতো।”
মাইকেল কুগেলম্যান বলছেন, “গত বেশ কিছুকাল ধরেই আমরা দেখছি বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সরকারের ক্র্যাকডাউনের সমালোচনা করেছে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।”
“এখন দেখা যাচ্ছে যে কূটনৈতিক পন্থার বাইরে গিয়ে তারা প্রয়োজনে ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ নিতেও ইচ্ছুক, এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত,” বলেন মাইকেল কুগেলম্যান।
অন্য কারণ আছে?
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পেছনে কোন কৌশলগত বিবেচনা কাজ করে থাকতে পারে কিনা? কিছু বিশ্লেষক মনে করেন বাংলাদেশকে ঘিরে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর যেসব পরিবর্তন হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য দেশটিকে চীনের প্রভাববলয়ের বাইরে রাখা।
তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ড. আনু আনোয়ার তা মনে করেন না। তিনি বলেন “এই নতুন ভিসা নীতির সাথে চীনকে মোকাবিলার কোন সম্পর্ক আছে এমনটা এক কথায় বলা চলে না।”
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র জানে যে বাংলাদেশে চীন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও অনেক এবং যুক্তরাষ্ট্র সচেতন যে বাংলাদেশ – দক্ষিণ এশিয়ার আরো অনেক দেশের মতই – ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই ভারসাম্য রেখে চলতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটাও দেখতে চায় যেন তারা চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে।”
তার কথায় – “ওয়াশিংটনে আজকাল স্ট্র্যাটেজির কথা বললেই তা চীনের সাথে জটিলতার লেন্স দিয়ে দেখা হয়। আমার তো মনে হয় অনেকেই যুক্তি দেবেন যে এ ধরনের (ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের মতো) নীতি নিলে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, কারণ তা ঢাকাকে চীনের আরো ঘনিষ্ঠ হবার দিকে ঠেলে দিতে পারে, বা এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বেজিং ঢাকার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে।”
“সেটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকুল হবে না। বরং বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানোর যে কথা আছে- তার আলোকে একে দেখাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়” – বলেন মি. কুগেলম্যান।
অন্য আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করছেন মাইকেল কুগেলম্যান।
“সম্ভবত বাংলাদেশকে ওয়াশিংটন এটা বোঝাতে চাইছে যে তারা কোন বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় – এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশে এমন একটা ধারণা অনেকের আছে যে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের বিরোধী, যেহেতু তারা এ সরকারের অনেক সমালোচনা করেছে। কিন্তু এই নতুন ভিসা নীতিতে এটা পরিষ্কার যে এর আওতায় সরকার ও বিরোধীদল উভয়ের লোকেরাই পড়বেন – যদি তারা অবাধ-সুষ্ঠূ নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন ।”
“ফলে এটা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যে একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিচ্ছে এ ধারণা জোরদার করার জন্যই নেয়া হয়েছে” বলেন তিনি।
কৌশলগত প্রশ্ন এবং চীন
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ
কিন্তু অনেকে এ ক্ষেত্রে একটা গুরুতর ‘স্ববিরোধিতাও’ কথা তুলে ধরেন।
তারা বলেন, পৃথিবীতে এমন অনেক দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা দেখা যায় যেখানে গণতন্ত্র বা নির্বাচন বলতে তেমন কিছুই নেই এবং যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন আছে। ওই দেশগুলোকে ফেলে ওয়াশিংটন হঠাৎ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কেন?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ড. আনু আনোয়ার বলছিলেন, কোথাও গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করে – আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী।
” কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সে অর্থে এটা অনুসৃত হয় না, কারণ ভূ-রাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নের মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে এবং আমার দেখা মতে সবসময়ই ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। ” – বলেন ড. আনোয়ার।
কিছু বিশ্লেষক আছেন যারা মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মত যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার পেছনে আসল উদ্দেশ্য এই ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ – গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকার নয়।
তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আসলে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব-বলয়ের বাইরে রাখতে চায়।
বাংলাদেশ অনেক বছর আগেই চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছিল।
গত ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেজিং-বিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটা করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
তার এ মন্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিলে একে “অপ্রত্যাশিত” এবং “দুর্ভাগ্যজনক” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বাংলাদেশ অবশ্য ‘কোয়াড’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগে’র অংশ নয়।
তবে এ দেশগুলো যে বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-র অংশ করতে চায় – তা মার্চ মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার এক বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য।
এ প্রেক্ষাপটে পরের মাসেই অর্থাৎ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করে ঢাকা।
তাতে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়’ – এ নীতির ভিত্তিতে ‘ভারসাম্যের’ পথ নেবার কথা ঘোষণা করে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শুক্রবার ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে কারো নাম উল্লেখ করা না হলেও যাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাদের বিষয়ে বলা হয়, এরা বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, বিচারবিভাগের সদস্য এবং নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আজ পররাষ্ট্র বিভাগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করেছে বা এর জন্য দায়ী কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দল’।
যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে সেসব ব্যক্তি তা তাদের পরিবারের সদস্যরা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
সেখানে আরো বলা হয়, ভবিষ্যতে আরো কোন ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করা বা এর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে তারাও একই ভিসা নীতির আওতায় পড়তে পারেন।
এতে বলা হয়, “আমাদের আজকের পদক্ষেপ বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যের প্রতি সমর্থনকে প্রতিফলিত করে। একই সাথে এই পদক্ষেপ যারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চান তাদের প্রতিও সমর্থন”।
এর আগে চলতি বছরের পঁচিশে মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা দিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র।
তখন বলা হয়েছিলো যে, এই নীতির আওতায় যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় – তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এ নীতি বাংলাদেশের তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
এরপরই মূলত রাজনৈতিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন হয় এবং বিরোধী দলগুলো নিয়মিত রাজনৈতিক সভা সমাবেশের সুযোগ পেতে শুরু করে।
তবে এর জের ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
এমনকি বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন যে ‘আমেরিকা হয়তো তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না”।
এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতর।
তবে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করে।
দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকেই ঢাকায় এসে সরকার ও বিরোধী দলসহ বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এ চাপের মধ্যেই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যেখানে মানবাধিকার ছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ এনে অবাধ বাজার সুবিধা (ইবিএ) বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কী-না সেই প্রশ্নও তুলেছেন। এ সুবিধার অংশ হিসেবে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় বাংলাদেশের পণ্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এর বড় সুবিধাভোগী।
এরপর ঢাকায় নির্বাচন কমিশন জানায় যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না বলে তাদের নিশ্চিত করেছে।
ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো থেকে পর্যবেক্ষক আসবে কি-না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র জানিয়েছেন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় আসবে।তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে যে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কি-না।
তথ্যসূত্র :বিবিসি বাংলা,যুগান্তর, প্রথম আলো