১৪০ কোটির ভারতীয়র স্বপ্নভঙ্গ ।।অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারত হেরে গেল
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে রবিবার রাতে ভারতের লক্ষাধিক সমর্থককে হতাশায় ডুবিয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রফি উঠল প্যাট কামিন্স ও তার দলের ক্রিকেটারদের হাতেই।জয়ের লক্ষ্যে ২৪১ রান তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া চার উইকেট হারিয়েই সেই টার্গেটে পৌঁছে যায়, তখনও ম্যাচের পুরো সাত ওভার বাকি।
১২ বছর পর বিশ্বকাপ জয় হল না। ১০ বছর ধরে আইসিসি ট্রফি না পাওয়ার খরা কাটল না। আমদাবাদে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারত হেরে গেল। এ বারের বিশ্বকাপে একটি মাত্র ম্যাচ হারল ভারত। আর সেটা ফাইনাল ম্যাচ। প্রথমে ব্যাট করে ২৪০ রান করা ভারতের বিরুদ্ধে ট্রেভিস হেডের শতরানে ভর করে অস্ট্রেলিয়া জিতল ৬ উইকেটে।
টস জিতে আগে বল করা হোক বা ফিল্ডিং সাজানো, সব দিকেই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বুদ্ধির ছাপ। ব্যাটিংয়েও সেটা দেখালেন হেড এবং মার্নাস লাবুশেন।
টস জিতে কামিন্স আগে বল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। বিশ্বকাপজয়ী প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিং ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় বলেন, “টস জিতে বল করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ বোঝা গেল না। এই পিচে আগে ব্যাট করে নিলেই বোধ হয় সুবিধা হত।” কিন্তু ২০০৩ বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে ভুল প্রমাণিত করলেন কামিন্স এবং অস্ট্রেলিয়ার বাকি বোলারেরা।
রোহিত এ বারের বিশ্বকাপে যে ভাবে খেলছিলেন, এই ম্যাচেও তার অন্যথা হল না। নেমেই দ্রুত রান তুলতে শুরু করেন তিনি। বড় শট খেলতে গিয়েই আউট হলেন। তখন তাঁর ৪৭ রান। কিন্তু নিজের ৫০ নয়, দলকে বড় রান দেওয়াই ছিল রোহিতের লক্ষ্য। সেটা করতে গিয়েই উইকেট দিলেন। আর তিনি আউট হতেই ধাক্কা খেল ভারত। রোহিত আউট হওয়ার পর ভারতের বাকি ইনিংসে হল মাত্র চারটি বাউন্ডারি। রোহিত নিজে তিনটি ছক্কা এবং চারটি চার মেরেছিলেন। বিরাট কোহলির মারা চারটি চারও এসেছিল রোহিত ক্রিজ়ে থাকাকালীন। ভারত অধিনায়ক আউট হতেই কেমন গুটিয়ে গেল ভারত।
টানা ১০টি ম্যাচ জিতে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। সেই জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই। ফাইনালে সেই অস্ট্রেলিয়া। যারা টানা আটটি ম্যাচ জিতেছে। বিশ্বকাপের বহু ম্যাচ ভারত একপেশে ভাবে জিতলেও বিশ্বকাপের ফাইনালে যে তা হবে না, সেটাই জানাই ছিল। পাঁচ বারের বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্বে হারলেও ফাইনাল অন্য ধরনের ম্যাচ। প্রথম ওভার থেকেই অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। ডেভিড ওয়ার্নার হয়তো তাঁর শেষ এক দিনের ম্যাচ খেলে ফেললেন। ৩৭ বছরের সেই ক্রিকেটার যে ভাবে ফিল্ডিং করলেন তা বাকিদের উদ্বুদ্ধ করতে বাধ্য। সেটাই হল। রোহিতের ক্যাচ নেওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বাউন্ডারির দিকে দৌড়ে বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে ট্রেভিস হেড ক্যাচ নিলেন। অন্য ফিল্ডারেরাও চার হতে দিচ্ছিলেন না। ভারতের অন্তত ৩০ রান আটকে দেন অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডারেরা।
বিরাট এবং রাহুল অবস্থা বুঝে সিঙ্গলস নিতে শুরু করলেন। কোনও বোলারকে মেডেন নিতে দেননি তাঁরা। ওভারে অন্তত চারটি করে সিঙ্গলস নিয়ে স্কোরবোর্ডকে সচল রাখলেন বিরাটেরা। ভারতীয় সমর্থকেরা আফসোস করছিলেন শ্রেয়স আয়ারের উইকেট হারানো নিয়ে। মাত্র চার রান করে আউট হয়ে যান তিনি। শ্রেয়স থাকলে আরও কিছু রান বেশি হতে পারত বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিত আউট হওয়ার চার বলের মধ্যেই আউট হন শ্রেয়স। ভারতের বড় ধাক্কা ছিল সেটা। বিরাট এবং রাহুলের কাছে উপায় ছিল না বড় শট খেলার ঝুঁকি নেওয়ার। তাই বিরাট ৬৩ বলে করলেন ৫৪ রান আর রাহুল ১০৭ বল খেলে করলেন ৬৬ রান। কামিন্সের বল বিরাটের ব্যাটে লেগে উইকেট ভেঙে দেয়। আর নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের ১ লক্ষের বেশি দর্শক হতাশায় চুপ করে যায়।বিশ্বকাপের ফাইনালে রান তাড়া করতে গিয়ে সেঞ্চুরি করার এটি তৃতীয় নজির – যার মধ্যে দিয়ে ক্লাইভ লয়েড ও অরবিন্দ ডি সিলভার সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে ঢুকে পড়ল ট্রেভিস হেডের নাম।
এছাড়াও ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে এর আগে শতরান করেছেন ভিভ রিচার্ডস, রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও মাহেলা জয়বর্ধনের মতো লেজেন্ডরাও।
গোটা টুর্নামেন্টে এযাবত অপরাজিত থাকার পর ভারত শেষ পর্যন্ত ফাইনালে এসেই মুখ থুবড়ে পড়ল – এদিনের ম্যাচে তাদের ব্যাটিং ও বোলিং দুইই ছিল চরম নিষ্প্রভ।
ব্যাটিং যেমন গোড়া থেকেই চাপের মুখে পড়েছিল, তেমনি বোলিং ইউনিটও শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার ওপর তৈরি করা চাপ ধরে রাখতে পারেনি।অস্ট্রেলিয়া ডেভিড ওয়ার্নার (৭), মিচেল মার্শ (১৫) ও স্টিভ স্মিথকে (৪) খুব অল্প রানের মধ্যে হারালেও সেখান থেকে ধীরে ধীরে দলকে অনায়াসে জয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যান হেড ও লাবুশেন।সেমিফাইনালে ভারতের জয়ের নায়ক মহম্মদ শামি এদিনও ওয়ার্নারকে তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ঝটকা দিলেও পরে আর কোনও উইকেট পাননি।
যশপ্রীত বুমরাও পর পর দুটো ওভারে মার্শ ও স্মিথকে আউট করেন – কিন্তু ভারতের বোলিং এর পর আর দাগ কাটতে পারেনি। উইকেটে রবীন্দ্র জাডেজা ও কুলদীপ যাদবও ভাল টার্ন পাচ্ছিলেন, কিন্তু তারাও কোনও উইকেট পাননি।ম্যাচের একেবারে শেষে ট্রেভিস হেডের উইকেট পান মহম্মদ সিরাজ – কিন্তু তখন অস্ট্রেলিয়ার জয় মাত্রই দু’রান দূরে।
এর আগে ফাইনালে ভারত প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়াকে জেতার জন্য ২৪১ রানের টার্গেট দিয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ভারতকে প্রথমে ব্যাট করতে পাঠালে স্বাগতিকরা নির্ধারিত ৫০ ওভারে ২৪০ রানে অল আউট হয়ে যায়, যেটাকে বিশেষজ্ঞরা ‘বিলো পার’ স্কোর, অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম বলেই মনে করছিলেন।
ভারতীয় ইনিংসে কে এল রাহুল সর্বোচ্চ ৬৬, এবং এছাড়াও ভিরাট কোহলি ৫৪ ও রোহিত শর্মা ৪৭ রান করেন।অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের মধ্যে মিচেল স্টার্ক ৫৫ রান দিয়ে ৩টি, হ্যাজেলউড ও প্যাট কামিন্স ২টি করে এবং জাম্পা ও ম্যাক্সওয়েল ১টি করে উইকেট পান।
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স টসে জিতে যখন প্রথমে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তা অনেক ক্রিকেট পন্ডিতকেই কিছুটা বিস্মিত করেছিল।
কামিন্স নিজে অবশ্য জানান, উইকেট তার শুকনো বলে মনে হয়েছে যাতে ব্যাটিং করা পরের দিকে সহজ হয়ে উঠতে পারে।
তা ছাড়া ‘ডিউ’ বা শিশিরও একটা ফ্যাক্টর। সন্ধ্যার পর এই মাঠে শিশির পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যখন বোলারদের জন্য বল গ্রিপ করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে।