১৪ দলের শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছে ২০টি আসনের প্রত্যাশা ছিল ।। ১৪ দলের শরিক নেতারা নতুন এক চ্যালেঞ্জে পড়েছেন
আগের তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি করে ভোটে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলীয় জোট। নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের নিশ্চয়তা পাওয়ার পর মনোনয়নপত্র জমা দেন জোটের নেতারা।
বৈঠকে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ১৪ দলের জোটের শরিকদের কোন আসন ছেড়ে দেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে টানা দুইদিন বৈঠক হয়েছে । কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নেতারা চাইছেন নৌকার হয়ে নির্বাচন করতে। কিন্তু এবার জোট নিয়ে শুরুতে ভিন্ন চিন্তা করেছিল আওয়ামী লীগ। শরিক দলের চাপে শেষ মুহূর্তে আসন ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এবারে প্রতি আসনে স্বতন্ত্র বা বিকল্প প্রার্থী রাখার কৌশল নেয়ায় ১৪ দলের শরিক নেতারা নতুন এক চ্যালেঞ্জে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের তরফে আসন ছেড়ে দেয়া হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ে নামতে হবে তাদের। এ ছাড়া শীর্ষ নেতারা ছাড় পেলেও শরিক দলের অন্য নেতাদের বিষয়ে এবার ছাড় দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন দল। এতে শরিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পরে গতকাল জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতা আমির হোসেন আমুর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন জোটের কয়েকজন নেতা।
কিন্তু কোনো বৈঠকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলো যে পরিমাণ আসনে ছাড় পাওয়ার আশা করেছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া ছাড় দেয়া হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় দলগুলোতে হতাশা দেখা দিয়েছে।
কেউ কেউ নৌকা প্রতীক পেলেও নির্বাচন করবেন কিনা তা নিয়ে রয়েছেন সংশয়ে। জোটের একজন শীর্ষনেতা তার ঘনিষ্ঠদের জানিয়েছেন, বয়স অনেক হয়েছে। এই বয়সে যদি নির্বাচনে পরাজিত হতে হয় তাহলে মানসম্মানের বিষয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি চাইলে নৌকা প্রতীকের পাশাপাশি দলের বিদ্রোহী-স্বতন্ত্রদেরও বসিয়ে দিতে পারেন। এটা করলে নির্বাচনে আছি, না করলে নির্বাচনে নাই।
যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, স্বতন্ত্রদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। কারণ তাদের উদ্দেশ্য আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। আওয়ামী লীগ ও জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ জোটের চার নেতাকে আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে। এ সংখ্যা হয়তো আরও দুই থেকে তিনটি বাড়তে পারে।
যে চারটি আসন শরিক ১৪ দলের জন্য ছেড়ে দিতে আওয়ামী লীগ একমত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- কুষ্টিয়া-২ আসনে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, আগে থেকেই এই আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। রাশেদ খান মেনন এবার বরিশাল-২ অথবা বরিশাল-৩ আসন থেকে নির্বাচনে করবেন এবং যে আসনটিতে তিনি নির্বাচন করতে চান তা আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেবে। পিরোজপুর-২ আসনটি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে এবং চট্টগ্রামের একটি আসন সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর জন্য ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান। অন্যদিকে আরও দুটি আসন নিয়ে দেন-দরবার চলছে জোটের নেতাদের সঙ্গে। আসন দুটি হচ্ছে- রাজশাহী-২ আসন, এখানে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এ ছাড়া জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আসন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
সোমবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, একটি লিয়াজোঁ কমিটি কাজ করবে এবং দুই একদিনের মধ্যে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করবে। বৈঠকে ১৪ দলের শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছে অন্তত ২০টি আসন প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের জানিয়েছেন, যারা বিজয়ের জন্য যোগ্য তাদেরকেই শুধু মনোনয়ন দেয়া হবে। কারণ, এবারের নির্বাচন একটি ভিন্ন ধরনের নির্বাচন হতে চলেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। যদি বিজয়যোগ্য প্রার্থী না হয় তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়ে যাবে। এ কারণেই তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ১৪ দলের শরিকদের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার অনুরোধ জানান। তবে, ১৪ দলের পক্ষ থেকে শিরীন আখতারসহ আরও কয়েকজনের নামের তালিকা দেয়া হয়েছে।
গতকাল ১৪ দল নিয়ে ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আজকে না হয় আগামীকালের মধ্যে আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এটি নিয়ে কোনো মনোমালিন্য নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, এবারের নির্বাচনটি রাজনৈতিক কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
তবে গতকাল রাতে জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু জানিয়েছেন, জোটের আসন চূড়ান্ত করতে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে প্রাথমিকভাবে আওয়ামী লীগ যেসব আসনে ছাড় দিতে রাজি হয়েছে সেই ৪টি আসনেও শক্ত অবস্থানে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাই এসব আসন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন শরিক দলের নেতারা।
কুষ্টিয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগ নিজেদের কোনো প্রার্থী রাখেনি। এ আসন থেকে ২০০৮ সাল থেকে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এবারো তাকে এ আসনটি ছাড় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তবে এ আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহারে চাপ দেয়া হবে না। জেলার মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটিতে ইনুকে লড়তে হবে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিনের সঙ্গে। নির্বাচনে লড়তে কামারুল আরেফিন মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এ ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে আরও রয়েছেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল ডা. এসএম মুস্তানজিদ। আসনটিতে কামারুল আরেফিনের শক্ত অবস্থান রয়েছে বলে জানা গেছে। তাছাড়াও কামারুল আরেফিনকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সমর্থন করছেন এমন আলোচনাও আছে।
পিরোজপুর ২ আসনে কানাই লাল বিশ্বাসকে মনোনয়ন দেয়া হলেও জাতীয় পার্টি- জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে আসনটি ছাড়তে রাজি হয়েছে আওয়ামী লীগ। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন একাদশ সংসদে লড়েছিলেন ঢাকা-৮ আসনে। কিন্তু এ আসনটিতে এবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে। ঢাকা- ৮ হাতছাড়া হওয়ার পর বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়ন জমা দেন মেনন। সেখান থেকে বরিশাল-৩ আসনটি ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেননকে ছাড় দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যদিও আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল সরদার মো. খালেদ হোসেনকে। তাকে সরিয়ে নিলেও মেননকে এ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। আসনটিতে তার ভালো অবস্থান রয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম-২ আসনে আওয়ামী লীগ খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে মনোনয়ন দিলেও আসনটি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে। তিনি এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তবে নজিবুল বশরকে লড়তে হবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু তৈয়বের সঙ্গে। আবু তৈয়বের ফটিকছড়িতে ভালো ভোট ব্যাংক রয়েছে বলে জানা গেছে।
ওদিকে গতকাল সন্ধ্যায় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে বৈঠক শেষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জোটের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক এবং রাতের খাবারের মধ্যদিয়ে এই বার্তা পরিষ্কার যে, জোট আছে, জোট একসঙ্গে নির্বাচন করবে। আসন ভাগাভাগির বিষয়টা আমরা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবো। তিনি বলেন, যেখানে জোটের প্রার্থী আসবে, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উঠে যাবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে দলীয় কৌশল কী হবে সেটা বিবেচনা করার জন্য আমরা শেখ হাসিনাকে বলেছি। এখনো সময় আছে, আলোচনা করে দেখবো। প্রার্থীরা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করবে।
বৈঠক শেষে আমির হোসেন আমু বলেন, জোটের আসন বিন্যাস ও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গত সোমবার আমাদের ১৪ দলের নেত্রী একটি সভা করেছেন। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তখন আসনের বিষয়ে কথা উঠে এসেছে।
ওদিকে গত সোমবার গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জোটের আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসন আমুকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিমকে জোটের দলগুলোর সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, এবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) আসন চেয়েছে ৮টি। বর্তমানে দলটির সংসদ সদস্য আছেন ৩ জন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আসন চায় ৭টি। এই সংসদে দলটির সংসদ সদস্য আছেন ৩ জন। তরীকত ফেডারেশনের বর্তমানে একজন সংসদ সদস্য থাকলেও এবার ৫টি আসন আশা করছে। জাতীয় পার্টি (জেপি) ৫টি আসন দাবি করলেও, বর্তমানে দলটির একজন সংসদ সদস্য আছেন। সাম্যবাদী দলের কোনো সংসদ সদস্য না থাকলেও, এবার একটি আসন চায় তারা। জোটের বাকি শরিক দলগুলোর বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রত্যাশাও কম।
তথ্যসূত্র: মানবজমিন