বেইলি রোডের ভবনে আগুনে বেঁচে যাওয়াদের কথা।। নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে
রাজধানীর বেইলি রোডে সাত তলা একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ আগুনে নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর চলছে।
ঢাকার জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নিহত ৪৬ জনের মধ্যে ৩৮ জনের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। এখনো পর্যন্ত সাত জনের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি।এখনো ৮টি মরদেহ হস্তান্তর বাকি রয়েছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪ জন, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ১০ জন এবং পুলিশ হাসপাতালে এক জন মারা গেছে।
বেইলি রোডের ভবনে আগুনে বেঁচে যাওয়াদের কথা
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমেদ কামরুজ্জামানের গল্পটা অনেকটা তেমনই। তিনি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ঐ ভবনের ছয় তলার একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন।
মি. কামরুজ্জামান বলছিলেন রাত পৌনে দশটার দিকে তারা খাবার অর্ডার দিয়ে যখন রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিলেন, তখনই ভবনে আগুন লাগার বিষয়টি টের পান তিনি।
“প্রথমে আমরা ধোঁয়ার গন্ধ পাই, পরে হইচই শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সামনের বিল্ডিংয়ের নিচে মানুষ জড়ো হয়ে আমাদের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে, হাত তুলে হইচই করছে। তার কিছুক্ষণ পরই যখন ধোঁয়া উপরে উঠতে থাকে, তখন বুঝতে পারি যে আমাদের ভবনেই আগুন লেগেছে।”
ভবনে আগুন লেগেছে বোঝার পরই মি. কামরুজ্জামান তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভবনের ছাদের দিকে চলে যান।
“ছাদে যাওয়ার সময়ই সিঁড়িতে মানুষের প্রচণ্ড হুড়াহুড়ির মধ্যে পড়ি। ততক্ষণে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেছে, অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, প্রচণ্ড ধোঁয়ায় সবাই কাশছে, মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন সিঁড়িতে পড়ে গেছে – রীতিমতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল”, বলছিলেন মি. কামরুজ্জামান।
রাত দশটার দিকে তিনি তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। সেসময় আরো অন্তত ৪০ জন তাদের সাথে ছাদে অবস্থান করছিল বলে জানান তিনি।
“ছাদে রেস্টুরেন্ট আর নামাজের জায়গা থাকায় ছাদের পেছন দিকের ২৫ শতাংশ জায়গাই খোলা ছিল। সেখানেও এক কোনায় আমরা সবাই জড়োসড়ো হয়ে অপেক্ষা করছিলাম কারণ সিঁড়ি দিয়ে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ আসতে থাকায় তার ধারে কাছে আমরা থাকতে পারছিলাম না।”
রাত দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ছাদে অপেক্ষা করার পর ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনের সাহায্যে মি. কামরুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিচে নামানো হয়।
মি. কামরুজ্জামানের মতো অনেকে ভবনের ছাদে অপেক্ষা করলেও কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে লাফিয়ে নেমেছেন ছাদ বা জানালা দিয়ে। ভবনের নিচ তলার রেস্টুরেন্ট মেজবানি খানায় কাজ করা ইকবাল হোসেন তাদেরই একজন। মি. হোসেনের সাথে কথা হচ্ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে।
যে সময় আগুন লাগে, ইকবাল হোসেন তখন তিনি রেস্টুরেন্টের ভেতরেই ছিলেন। আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর তিনি পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় কোমড় ও পায়ে চোট পান।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ইকবাল হোসেন জানাচ্ছিলেন, “সাড়ে নয়টার পরপর হইচই শুনে রেস্টুরেন্টের গেট থেকে বের হয়ে দেখি বিল্ডিংয়ের মেইন গেটের কাছে আগুন। সেখান দিয়ে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই আর অনেক ধোঁয়া আসছে সিঁড়ির দিকে। তখন আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে চলে যাই।”
ইকবাল হোসেন বলছিলেন, সিঁড়ি দিয়ে দোতলা-তিনতলা পর্যন্ত উঠে সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন তিনি। ততক্ষণে নিচের তলা আর দোতলায় থাকা রেস্টুরেন্টগুলো থেকে মানুষ বের হয়ে সিঁড়িতে জড়ো হচ্ছিলেন।
“সিঁড়িতে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। ততক্ষণে সিঁড়ি ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছিল, কেউ শ্বাস নিতে পারছিল না, চোখেও দেখা যাচ্ছিল না কিছু।”
তখন ইকবাল হোসেন পাঁচতলার একটি রেস্টুরেন্টে যান এবং ঐ রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের গ্রিলের সরু ফাঁক গলে বের হন।
ইকবাল হোসেন বলছিলেন, “সেসময় অনেকেই জানালা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গ্রিলের ফাঁক সরু থাকায় অনেকেই বের হতে পারেননি।”
ইকবাল হোসেনের মত ঝুঁকি নিয়ে বের হয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু অনেকে সেই সুযোগও পাননি। ধোঁয়ায় আবদ্ধ সিঁড়িতে অথবা ঐ ভবনের কোনো একটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিশ্বাস নিতে না পেরে মারা যেতে হয়েছে অনেককে।
আগুন লাগা ভবনটি শান্তিনগর মোড় থেকে বেইলি রোডে ঢুকে কয়েকশো গজ গেলেই দেখতে পাওয়া যায়। ঐ ভবনের পাশের ভবনটিতেও তিন-চারটি রেস্টুরেন্ট ও কয়েকটি কাপড়ের দোকান। পাশের ভবনটির উপরে কয়েকতলা আবাসিক স্থাপনাও রয়েছে।
এই ভবন দুটির আশেপাশের পুরো এলাকার চিত্রই অনেকটা একইরকম। রাস্তার দু’পাশের অধিকাংশ ভবনই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হয়। সেসব ভবনে শপিং মলের পাশাপাশি খাবারের দোকানের আধিপত্য দেখা যায়।
সকালে আগুন লাগা ভবনের সামনে জড়ো হয়ে আগেরদিনের দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন স্থানীয়দের অনেকে। তারা বলছিলেন, ঐ ভবনের সাথে লাগোয়া কোনো ভবন না থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারেনি, ফলে আগুনের ব্যপ্তি একটি ভবনেই সীমিত ছিল।
কিন্তু আগুন একটি ভবনে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছিল তীব্র। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অন্তত ১২ জন।
শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন জানান মারা যাওয়াদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস নিতে না পেরে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে উত্তপ্ত ধোয়া প্রবেশ করায় শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছ মৃত্যু হয়েছে অনেকের, আহতদের অনেকেও শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি ভিড় থাকে। সাত তলা ঐ ভবনে অন্তত ছয় থেকে সাতটি রেস্টুরেন্ট থাকায় ঐ ভবনে সবসময়ই গ্রাহকের কিছুটা অতিরিক্ত ভিড় থাকতো বলে স্থানীয়রা বলছিলেন।
“আসরের পর থেকে আমরা ফুড ডেলিভারি সার্ভিস রাইডাররা এই বিল্ডিংয়ের সামনে জড়ো হয়ে আড্ডা দিতাম, কারণ এই এলাকার অর্ডারের একটা বড় অংশই থাকতো এই বিল্ডিংয়ে থাকা রেস্টুরেন্টে”, বলছিলেন একটি খাবার ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা মুজিবুর রহমান, যিনি কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘদিন ঐ ভবনের ভেতরে আসা-যাওয়া করেছেন বলে জানান।
তিনি বলছিলেন, “বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি আর লিফট পাশাপাশি। সিঁড়িতে একসাথে সর্বোচ্চ তিন জন উঠা-নামা করতে পারবেন, লিফটে একসাথে সর্বোচ্চ ছয়-সাত জন ঢোকা সম্ভব।”
তিনি বলছিলেন ঐ একটি সিঁড়ি আর লিফট বাদে ভবনে ঢোকার ও সেখান থেকে বের হওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
এছাড়া ভবনের নিচতালার এক কোণায় দু’টি টয়লেট ও একটি ছোট রান্নাঘর ছিল বলে জানান তিনি। মুজিবুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী, ঐ টয়লেটগুলোর পাশেই জড়ো করা থাকতো অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার। ঐ গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরণ হওয়ার কারণেই আগুনের ভয়াবহতা বেশি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও প্রাথমিক তদন্ত শেষে বলা হয়েছে যে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে সিঁড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, যে কারণে সিঁড়ি দিয়ে মানুষ নামতে পারেনি।
আগুনের প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলছেন আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েছেন তারা। ঐ ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করা ইকবাল হোসেনও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার কথা বলেছিলেন।
“আগুনটা যখন লাগে, প্রথম পাঁচ-সাত মিনিট মনে হচ্ছিল যে কিছু্ক্ষণের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আশেপাশের মার্কেট থেকে পুলিশ সদস্যরা ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার নিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকে”, বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন, যিনি বৃহস্পতিবার রাতে সাড়ে নয়টার পর ঐ ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন।
“ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশারগুলো দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করার সময় আগুন একটু কমে আসছিল, আবার এক্সটিঙ্গুইশার কয়েক মিনিট পর শেষ হয়ে গেলে আবার আগুন বেড়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ভেতরে একটি বিস্ফোরণের শব্দ পাই, তখন আমরা ভবনের সামনে থেকে সরে আসি”, বলছিলেন মি. হোসেন।
মোশাররফ হোসেনের মত অনেকেই মনে করেছিলেন যে আগুনের ব্যাপকতা খুব বেশি নয় আর হতাহতের সংখ্যাটাও হয়তো খুব বেশি হবে না। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্রে নিহতের সংখ্যাটা দেখে রীতিমত চমকে ওঠেন অনেকে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা