যে বিএনপি নেতারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে এবং সেগুলো কেন পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আজ বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় এ বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, যে বিএনপি নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন, তাঁদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তাঁদের বউদের কাছ থেকে সেই শাড়িগুলো এনে কেন পুড়িয়ে দিচ্ছেন না।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি এখন বলব আমাদের এই বিএনপি নেতাদের, যাঁরা যাঁরা ভারতীয় পণ্য বর্জন করবেন, সবাই বাড়িতে গিয়ে তাঁদের বউরা যেন কোনোমতে কোনো ভারতীয় শাড়ি না পরেন। তাঁদের আলমারিতে যে কয়টা শাড়ি আছে, সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেই দিন বিশ্বাস করব যে আপনারা সত্যিকার ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।’
ভারত থেকে গরমমসলা, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা আমদানির কথা তুলে এগুলো বিএনপি নেতারা রান্নায় ব্যবহার করবেন কি না, সে প্রশ্নও তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মসলাপাতি, আদা যা কিছু আসছে, তাদের কারও পাকের ঘরে যেন এই ভারতীয় মসলা না দেখা যায়। তাদের রান্না করে খেতে হবে এইসব মসলাবিহীন। কাজেই এটা তারা খেতে পারবেন কি না, সেই জবাবটা তাদের দিতে হবে।’
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক কেন
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো আহবান নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ ধরনের আহবান জানাতে দেখা গেছে। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা বলে থাকেন এই বিরোধীরা।তবে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ ধরনের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি অংশ ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন।এরকম কোন কোন গ্রুপে লক্ষ্যাধিক সদস্য থাকতেও দেখা গেছে।
ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার অলি-গলিতে এক তরুণ হ্যান্ডমাইক হাতে ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচারণা চালাচ্ছেন।সেই যুবক গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়।
সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের কন্টেন্টগুলোতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কটইন্ডিয়ানপ্রোডাক্টস’ হ্যাশট্যাগের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টির মতো কয়েকটি দলের নেতা-কর্মীরা গত সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে নানাভাবে ভারত-বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
সর্বশেষ বিরোধী দল বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাকে এই ক্যাম্পেইনের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভারত নিয়ে ‘জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলেই’ এটি রাজনৈতিক আলোচনায় এসেছে।
“নির্বাচন আসলেই ভারত কোনও রাখঢাক না করেই সক্রিয় হয় বলেই মানুষ ভোট দিতে পারেনি বা বঞ্চিত হয়েছে। সে বঞ্চনা থেকেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ কমানোর কাজ তো বিএনপির না”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়ানো’।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভা : ‘ভারতবিরোধিতা’ প্রশ্নে আলোচনা, সিদ্ধান্ত পরবর্তী বৈঠকে
‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ বিষয়টিকে একটি ‘সামাজিক আন্দোলন’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। এতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সরাসরি যুক্ত হওয়াটা সঠিক হবে বলে মনে করছেন না দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা। তবে এরই মধ্যে আলোচনায় আসা এই সামাজিক আন্দোলন বিএনপি উপেক্ষা করবে, নাকি কৌশলী অবস্থান নেবে—সে ব্যাপারে দলটি এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়সহ আসন্ন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। তবে কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তী বৈঠকে দুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি দলের একজন দায়িত্বশীল নেতার ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণার প্রসঙ্গ তুলে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি বৈঠকে আলোচনায় আনেন। একজন সদস্য জানতে চান, ভারতীয় পণ্য বর্জনে তাঁর ঘোষণা দলীয় সিদ্ধান্তে কি না, সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলে সেটি কোথায় হয়েছে। আরেক সদস্য প্রশ্ন তোলেন, বিএনপি ক্ষমতাপ্রত্যাশী একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এখন ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দল ক্ষমতায় গেলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কী হবে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় পণ্য বর্জনে রিজভীর সংহতি প্রকাশের বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটিকে জানান, রুহুল কবির রিজভী তাঁর ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধ থেকে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিষয়টি তিনি গণমাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন।
প্রসঙ্গত, বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২০ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এরপর তিনি নয়াপল্টনের বিএনপির কার্যালয়ের সামনে নিজের ব্যবহার করা ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীরা সেখানে চাদরটি আগুন দিয়ে পোড়ান। এর তিন দিন পর রিজভী আরেক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনে তাঁরা যে সংহতি জানিয়েছেন, তা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপমান, লাঞ্ছনা, ক্ষোভ থেকে এটি করছেন।
এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিজভী তো বলেই দিয়েছেন, এটা (ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহিত প্রকাশ) তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।’
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে কমিটির দু-একজন সদস্য উষ্মা প্রকাশ করলেও বৈঠকে সবাই এ বিষয়ে একমত যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করতে ভারত প্রত্যক্ষভাবে যে ভূমিকা রেখেছে, তা বাংলাদেশের জনমত এবং গণতন্ত্রের বিপক্ষে। বিষয়টি সামনে রেখে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের মূল্যায়ন এবং দেশটির পণ্য বর্জনে গড়ে ওঠা সাম্প্রতিক সামাজিক আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করা দরকার।
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, এ বিষয়ে (ভারতীয় পণ্য বর্জন) সিরিয়াস কোনো আলোচনা হয়নি। এটার জন্য আরও আলোচনা হবে।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করছেন, দেশে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে নির্বাচনের পর ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এটি সামাজিক আন্দোলন। কারণ, জনগণ মনে করছে, আওয়ামী লীগকে এতটা ‘বেপরোয়া’ এবং ‘দুর্বিনীত’ করতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সহযোগিতা করছে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র। এতে বিএনপি প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া সঠিক হবে না।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক সামাজিক আন্দোলন মনে করেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা তো সামাজিক আন্দোলন। এটাকে পার্টিজান করা ঠিক নয়, এতে বিএনপির যুক্ত হওয়ার দরকার নেই। সামাজিক আন্দোলন সাধারণ মানুষের বিবেকবোধের আন্দোলন, এটা এভাবেই চলা উচিত।
তথ্য সূত্র : প্রথম আলো, বিবিসি