হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্টের শাহাদাত; কে হচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট?
ইরান-আজারবাইজান সীমান্তবর্তী একটি জলাধার উদ্বোধন করে ফেরার পথে রোববার ইরানের প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের ‘দিরমাজ’ জঙ্গলের আকাশে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে দুর্ঘটনা কবলিত হয়। হেলিকপ্টারটিতে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তাবরিজের গভর্নর ও তাবরিজের জুমার নামাজের ইমাম ছিলেন।
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবর প্রচারিত হওয়ার ফলে সারা ইরানে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রেসিডেন্ট রায়িসি স্বল্প সময়ের দায়িত্ব পালনকালে ইরানি জনগণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছেছিল। অত্যন্ত সাধাসিধে জীবনযাপন, সদাচারণ এবং ব্যাপক পরিশ্রম করার কারণে মানুষ তাকে ভালোবাসত। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রায়ই সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অফিস করেছেন। নিঃসন্দেহে এমন একজন প্রেসিডেন্টের মৃত্যু মেনে নেয়া ইরানি জনগণের জন্য সহজ ছিল না। তারা দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই দলে দলে মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় স্থানে সমবেত হয়ে আল্লাহর দরবারে প্রেসিডেন্টের সুস্থতার জন্য দোয়া করতে থাকেন। রোববার সারারাত একদিকে চলে উদ্ধার তৎপরতা অন্যদিকে চলে দেশবাসীর দোয়া। কিন্তু ইরান সময় সোমবার সকাল ৭টার দিকে খবর আসে হেলিকপ্টারের কোনো আরোহী বেঁচে নেই।
প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে কে দায়িত্ব পালন করবেন?
ইরানের সংবিধানের ১৩১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে: মৃত্যু, বরখাস্ত, পদত্যাগ কিংবা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রেসিডেন্ট দুই মাসের বেশি অনুপস্থিত থাকলে অথবা প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোনো কারণে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেরি হলে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনক্রম প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট স্পিকার ও বিচার বিভাগের প্রধানের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ পরবর্তী ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
বর্তমানে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবের। গতকাল হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই তার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক হয়েছে। সর্বোচ্চ নেতা অনুমোদন করলে এখন তিনি আগামী ৫০ দিনের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে চলে যাবে রাষ্ট্রের দায়িত্বভার।
এখন প্রেসিডেন্ট রায়িসির শাহাদাতের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করে এবং গত প্রায় পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ইরান বিগত বছরগুলোতে এর চেয়েও কঠিন সময় খুব ভালোভাবে পার করে এসেছে এবং নিজের বয়সের পূর্ণতা প্রমাণ করেছে। যেমনটি প্রবাদে বলা হয়েছে, “যা তোমাকে হত্যা করতে পারবে না তা তোমাকে শক্তিশালী করবে।”
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার শোকবার্তা
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মুখবের, পালিত হবে ৫ দিনের জাতীয় শোক
সর্বোচ্চ নেতা (বামে) ও রায়িসি (ডানে)
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ তাদের সফরসঙ্গীদের শাহাদাতের ঘটনায় শোকবার্তা দিয়েছেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তিনি শোকবার্তায় বলেছেন, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জন-নন্দিত, যোগ্য ও পরিশ্রমী প্রেসিডেন্ট জনাব হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি ও তার সফরসঙ্গীদের শাহাদাতের তিক্ত খবরটি পেয়েছি। এই দুঃখজনক ঘটনাটিও ঘটেছে যখন তিনি (রায়িসি) সেবামূলক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই সম্মানিত ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তির নানা দায়িত্ব পালনের পুরো সময়টা সম্পূর্ণরূপে জনগণ ও ইসলামের সেবায় নিরলস প্রচেষ্টায় অতিবাহিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও এটা একই রকম ছিল। প্রিয় রায়িসি ক্লান্তি কি জিনিস তা যেন জানতেনই না।
সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, তাঁর কাছে মানুষের কল্যাণ ও সন্তুষ্টি সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার পেতো। এটা আল্লাহর সন্তুষ্টিরই ইঙ্গিতবাহী, তাই কিছু অসাধু মানুষের পক্ষ থেকে অকৃতজ্ঞতা এবং উপহাস তাঁর জন্য পীড়াদায়ক হলেও এসব কিছুই তার দিনরাতের কাজ-কর্ম এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, এই কষ্টদায়ক ঘটনায় তাবরিজের জুমার নামাজের ইমাম হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেম, সংগ্রামী ও সদাসচেষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দুল্লাহিয়ান এবং তাদের অন্য সফরসঙ্গীরা শহীদ হয়েছেন। এই ঘটনায় আমি পাঁচ দিনের সার্বজনীন শোক ঘোষণা করছি এবং ইরানের প্রিয় জনগণের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মুখবের দেশের নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন এবং তিনি সংসদ স্পিকার ও বিচার বিভাগের প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।
গতকাল (রোববার) আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ (জলাধার) উদ্বোধন করতে যান ইব্রাহিম রায়িসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আরেকটি প্রকল্প পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। প্রেসিডেন্ট গতকাল সকালে তেহরান থেকে বিমানে করে তাবরিজে পৌঁছান এবং সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে জলাধার উদ্বোধনের স্থানে পৌঁছান।
ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি’র মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ (সোমবার) প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এবিএম সারওয়ার-ই-আলম সরকারের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়িসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এবং তাদের সঙ্গীরা নিহতের ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি জ্ঞানী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। তিনি তার দেশের জনগণের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন ও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ছিলেন অনন্য উচ্চতায় এবং তার অনুকরণীয় নেতৃত্ব আমাদের জন্য আদর্শ।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইরানের প্রেসিডেন্টসহ নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। পাশাপাশি ইরানের জনগণ—এই শোক কাটিয়ে উঠবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে মরদেহ উদ্ধার করে নেয়া হবে তাবরিজে
ঘন কুয়াশার কারণে রোববার রাতে উদ্ধার তৎপরতা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তবে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজে গতি বাড়ে।
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি জানায়, প্রথমে তুরস্কের বায়রাকতার আকিঞ্জি ড্রোন অবস্থান সনাক্ত করে। সেখানকার অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ ইরানি কর্তৃপক্ষকে জানায় তারা।
পরে উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
রেড ক্রিসেন্ট সদস্য ও অন্যদের ধারণ করা বিভিন্ন ভিডিও প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।
তাতে দেখা যায়, স্ট্রেচারে করে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি অসমতল পথে তাদেরকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।
ইরানের বিপ্লবী গার্ডস এর ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানায়, সবগুলো মরদেহই তাবরিজে নিয়ে যাওয়া হবে। কাল শেষকৃত্যের আগ পর্যন্ত সেখানকার ফরেনসিক বিভাগেই থাকবে লাশ।
প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং তার সহচরদের গন্তব্যই ছিল তাবরিজ শহর।
আরেকটিতে ভিডিওতে, হেলিকপ্টারের একটি দরজা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। দরজায় লেখা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। সেখানে সমবেত হয়ে আছেন অনেকে। পোশাক দেখে যাদের সেনাসদস্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে জড়ো হয়েছেন ইরানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা।


মন্ত্রিসভায় অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের বক্তব্য
ইরানের মন্ত্রিসভার বৈঠকে বক্তব্য রেখেছেন নবনিযুক্ত অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার।রয়টার্সের ছবিতে দেখা যায়, বৈঠকে মাঝখানের আসনটি ফাঁকা রাখা হয়েছে।তাতে কালো উত্তরীয়’র মতো একটি কাপড় রাখা।
তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈঠকটি।আগামী প্রায় দুই মাসের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন মি. মোখবার।

তথ্যসূত্র:পার্সটুডে, বিবিসি বাংলা