দেশে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বন্যার প্রভাবে বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাত বিশেষ করে শিল্প, পর্যটন, কৃষি ও সেবা খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ।। নিত্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সাধারনের নাগালের বাইরে
অর্থনৈতিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে গত দুই মাসে সিটি গ্রুপ, বিএসআরএম, ইউএস-বাংলাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গ্রুপের দেড় শতাধিক কম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৮৩টি কম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধের যে ধারা, তাতে বিশ্লেষকরা একে কিছুটা অস্বাভাবিক বলছেন। কারণ গত অর্থবছরে ২৭৫টি বন্ধ করা হলেও এ অর্থবছরের গত তিন মাসের যে ধারা তাতে ধারণা করা হচ্ছে যে অর্থবছর শেষে এই সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
এ অবস্থায় ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি না হলে আরো কম্পানি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এমনকি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগ না থাকায় নতুন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা।কম্পানিগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী অবসায়নের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে কম্পানিগুলো। এরই মধ্যে ১৬০টি কম্পানির বন্ধের প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। বন্ধের তালিকায় ছোট প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনি বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে নিবন্ধিত এসব কম্পানির মধ্যে পণ্য সরবরাহ ও সেবাদানকারী উভয় খাতের প্রতিষ্ঠান আছে।
এ ছাড়া নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে নিবন্ধন নেওয়া কম্পানিও বন্ধের তালিকায় রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বন্যার প্রভাবে বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাত বিশেষ করে শিল্প, পর্যটন, কৃষি ও সেবা খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন শ্রম অসন্তোষের কারণে দেশের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা চলছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরো বিপাকে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। দেশে সরকার পরিবর্তনের পরে গত দুই মাসে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৬১টি কম্পানি।
এরই মধ্যে বেশ কিছু কম্পানি আরজেএসসিতে বন্ধের আবেদনসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে। আবার কিছু কম্পানি সাধারণ সভার বৈঠকে কম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এভাবে কম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
এ কে খান ওয়াটার হেলথ (বাংলাদেশ) লিমিটেড বন্ধে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এ কে খান গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লাভজনক না হওয়ায় কারখানা আগেই বন্ধ করা হয়েছিল। তবে আমরা আমাদের ব্যবসা সংকুচিত করছি না। ভিন্নভাবে আরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পিতার নামে মাদারীপুরে গড়া প্রতিষ্ঠান আসমত আলী খান সেন্ট্রাল হসপিটাল লিমিটেড বন্ধ হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি কম্পানি ল্যাব কোয়েস্ট বন্ধ হচ্ছে। এই কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিনকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় কম্পানি বিএসআরএম গ্রুপ। এই গ্রুপের বিএসআরএম রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধের জন্য সিফিক বসাক অ্যান্ড কোংকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়।
ডায়মন্ড গোল্ড ওয়ার্ল্ড ও ডায়মন্ড গোল্ড ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধের জন্য গত আগস্ট মাসে রহমান সৈয়দ জিল্লুর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট কম্পানি অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে। পেপার কাপ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইনটেক গ্রিনপ্যাক বন্ধ করতে অবসায়ক নিয়োগ করেছে। একই সময়ে অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছে আরবান ফিট প্রপার্টিজ, এস্কয়ার হোল্ডিং, ক্রিস্টাল আই, ভিসা ইনকরপোরেট, থ্রি এস ডিজাইন, উত্তর বাংলা ব্রোকারেজ, বুশরা অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্ম, হিট কনজিউমার, দ্য গোল্ডেন ব্রিকস প্রপার্টিজ, ফুডট্রি ইন্টারন্যাশনাল, ফালাক অ্যাগ্রো ফুড, এএএ ডিস্ট্রিবিউশন, আমাদের ভাবনা, টেক্স ডোর ইন্টারন্যাশনাল, নর্থ ল্যান্ড, স্যাটলো ইন্ডাস্ট্রিজ বিডি, সিটি টেকনো ভেঞ্চার অ্যান্ড লজিস্টিক ও ইউবিএস। আগস্টে কম্পানি বন্ধে দ্বিতীয় ইজিএম করেছে রিলায়েবল কেয়ার সলিউশন, রাডমেডিক্স, স্টিস সলিউশন, ভি পার্টনার বাংলাদেশ, স্কানডেক্স পাওয়ার, তাজ পোলট্রি অ্যান্ড ফিশ ফিড ও অ্যাভালন সফটওয়্যার।
গত সেপ্টেম্বরে কম্পানি বন্ধে প্রশাসক নিয়োগে ইজিএম করেছে এসবিআই ট্রেডিং, ট্রান্সকন মার্কেটিং, রহমা আয়রন, রে এ ওয়ান, দাওয়াই, ইস্টার্ন হোটেল অ্যান্ড বার, পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্ট, স্টারবাকস চাই, জেএইচএম ইঞ্জিনিয়ারিং, হলি হজ ট্যুর, আরকু রিটেইল, ব্রেইন্ড সার্ভিস, রিনাইন্সে ক্যালজোলিয়ো, রিনাইন্সে সার্ভিস, জিংপেং বির ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউলথনেস হেলথ টেক, বেস্ট ইন অ্যাগ্রো ফুডস, লিংআপ টেক্সটাইল, জেনেরিক সোর্স ইন্টারন্যাশনাল, এমএনএ অ্যাসোসিয়েটস, সিএবি ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট, সয়েলসেট, ভ্যালোসিটি এশিয়া, স্টারলিংকস প্রপার্টিজ, নিরব ডিজিটাল টেকনোলজি, আর্সান বিল্ড্রিম ও নিউরোলজিক।
কম্পানি বন্ধে গত সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় ইজিএম করেছে হাইপার ট্রেডিং, হ্যাপি টাইগার ইন্টারন্যাশনাল কম্পানি, ইশান স্ট্র্যাটেজি কনসাল্টিং, উইজার্ড সোয়েটার, ডরিক বাংলাদেশ, শুদ্ধ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, গুলজান, জারিফ বাংলাদেশ সোর্সিং, ওয়াশ এন ওয়ার্ক, একতা ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো, ইনজেনাস এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম, এফএনএম সোর্সিং, ব্লকবিডি, ফারিক অ্যাপারেল ভিলেজ, আইএফএন হোল্ডিং, প্রবি হোল্ডিংস, এসকেএম, অপটিমা অয়েল অ্যান্ড শিপিং লাইনস, ওন্ডার গ্যাস, সুপারসনিক ট্রেডার্স, সূচনা ট্রেডিং, এস টু এস ডেইরি ফার্ম, ওয়েজ আর্নার্স হোল্ডিং, আলেশা আর্কিটেক্ট, ২৪/৭ রিটেইল শপ, টিএ অ্যান্ড পিএ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রডাক্ট, পি অ্যান্ড ও এট্রিস, শেড ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল, এসএএফ বিল্ডিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সলিউশন, অ্যারাবি সুপার অটোরাইস, এস্কোয়ার হোল্ডিং, এম্বিয়েন্ট এভিয়েশন, আমিও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, দেয়ারম্যাক্স ডিস্ট্রিবিউশন, আরবান ফিট প্রপার্টিজ, গ্রিন ফার্ম হাউস ও লিংকআপ টেক্সটাইল।
চলতি অক্টোবরে কম্পানি বন্ধের জন্য ইজিএম করবে ড্রাগন ফার্টিলাইজার, সিটি টেকনো ভেঞ্চার, ফুডট্রি ইন্টারন্যাশনাল, আমাদের ভাবনা, ইলমিয়াত ওয়াশিং অ্যান্ড ডায়িং, অথেনটিক অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট, এএএ ডিস্ট্রিবিউশন, মিন্ডমুভার টেক, স্যাটলো ইন্ডাস্ট্রিজ ও ইনো সিরামিক্যাল। রয়েল বাংলা ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি বন্ধে গত আগস্ট মাসে এজিএম করেছে। বন্ধ হচ্ছে কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকানাধীন কাশেম ল্যাম্পস লিমিটেড, কাশেম ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড ও সানলাইট ট্রেডিং অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড।
বন্ধ হচ্ছে বিদেশি কম্পানি : দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কম্পানি ব্রাইড মেডিক্যাল অ্যান্ড এডুকেশন সার্ভিস লিমিটেড গত ১১ আগস্ট ইজিএমে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা স্বেচ্ছায় এটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতভিত্তিক আন্তর্জাতিক কম্পানি শিপকার্ড মেরিন বাংলাদেশ লিমিটেড স্বেচ্ছায় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাইট টেক ইন্টারন্যাশনাল (এসএ) লিমিটেড তাদের দ্বিতীয় ইজিএমে বন্ধের অনুমোদন করা হয়েছে।
গত আগস্টে জিনপেং ট্রেডিং কম্পানি বন্ধের জন্য অবসায়ক নিয়োগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেন সুহুই। বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে তাইওয়ানভিত্তিক মেরিল্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানিও। সিঙ্গাপুরভিত্তিক হুইডিং প্রাইভেট কম্পানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কম্পানি বন্ধের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কম্পানি বন্ধ হওয়ার বিষয়ে যৌথ মূলধন কম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা হবে। আসলে কতগুলো কম্পানি বন্ধ হয়েছে এবং এসব কম্পানি কী কারণে বন্ধ হচ্ছে, সার্বিক পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিক্রি হ্রাস, সুদের উচ্চ হার, শ্রম অসন্তোষ, পরিবহন ও কারিগরি সমস্যা, ডলার সংকটে কাঁচামালের ঘাটতি, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আকস্মিক বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করছে ব্যবসা-উদ্যোগ। পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কিছু কম্পানির ব্যবসা করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান মীর নাসির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে থেকেই দেশের অর্থনীতি সংকটে থাকায় বেশ কিছু কম্পানি সমস্যায় আছে। কিছু কম্পানি সংকট কাটাতে পারলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অতি দ্রুত এসব সমস্যা কাটিয়ে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হবে, এটা আশা করা যায়।’
ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠনসহ নানা উদ্যোগে খুব বেশি না হলেও অর্থনীতি স্থিতিশীলতায় কিছুটা স্বস্তি
রিজার্ভের ধারাবাহিক পতনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ডলার বিক্রি বন্ধ করেছে। ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এলসি খোলার ক্ষেত্রে নমনীয় করা হয়েছে শতভাগ মার্জিনের শর্ত। যদিও ব্যবসায়ীদের এখনো নির্বিঘ্নে এলসি খোলার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের সহনীয় মাত্রার বাইরে বিরাজকরছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। পাশাপাশি বিনিয়োগের নতুন পরিবেশ এখনো আসেনি। যে কারণে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ কিছুটা বন্ধ হয়েছে, তবে টেকসই কতটা হবে, সেটি অনেকটা অনিশ্চিত-এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সোমবার যুগান্তরকে তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি তিন বছর ধরে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। সার্বিকভাবে সেই অবস্থা এখনো রয়ে গেছে। গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কিছু কমার লক্ষণ দেখা গেলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির গতি থামছেই না, যা সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে ভোগাচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত এখন ঠিক হয়নি। নিরাপত্তার দিক থেকে স্বস্তিতে নেই। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প এলাকায় স্বস্তিদায়ক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ ছাড়াও হামলা-ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গেল সেপ্টেম্বরে দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই মাসে কিছুটা কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে বিরাজ করছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে অস্বস্তিতে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, এক্ষেত্রে সরকারের নজরও কম।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে সরকারের পরিচালনা ও উন্নয়ন ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া কৃষকের সার আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলারের সরবরাহ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পলিসি সুদের হার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ নির্ধারণ এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এছাড়া বাজার মনিটরিং বাড়ানো হচ্ছে। আলুসহ কয়েকটি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছু নীতি উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এটি না করলে অবস্থা আরও খারাপ হতো।
ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচার একধরনের পঙ্গু করে দিয়েছে ব্যাংক খাতকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। যার বড় অংশ পাচার হয়ে বিদেশে চলে গেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, দেশ থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। খেলাপি ঋণসহ ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে গঠন করা হয়েছে আরও একটি টাস্কফোর্স।
এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) সরকারের রাজস্ব আদায় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশ কম হয়েছে। এ সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৫ হাজার ৬৯ কোটি টাকা ঘাটতি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টানা পতনের মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। রিজার্ভ পরিস্থিতি বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে রাশিয়া ও চীন থেকে প্রাপ্য ঋণের সুদহার কমানো এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের কাছে। পাশাপাশি দুই মাসের মধ্যে বেশি নজর দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সংগ্রহের দিকে। নিয়মিত সহায়তার লক্ষ্যমাত্রার বাইরে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সহায়তা চাওয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি ডলার এবং জাইকার কাছে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। তবে বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে ১২০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি মিলছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ।
বাজার পরিস্থিতি আসলে কেমন
গত কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে ডিম আর কাঁচামরিচের দাম। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আজ মঙ্গলবার সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে অনুমতি দিয়েছে। এর আগে রোববার বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে এসেছে সাড়ে চার লাখ পিস ডিম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিনই ডিমের চাহিদা দেশে প্রায় পাঁচ কোটি পিস। মঙ্গলবার কয়েকটি বাজারে এক ডজন ডিম ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এছাড়া হুট করে ব্যাপক বেড়েছে কাঁচামরিচের দাম। মূলত সাম্প্রতিক বন্যা ও বর্ষার করণে বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ার সুযোগে কাঁচামরিচের দাম অনেক বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাজার ভেদে এর কেজিপ্রতি দাম এখন ৫৫০-৫৮০ টাকা।
নিয়মিত বাজারে যান ঢাকার শান্তিনগর এলাকার লাবনী আক্তার। তার দাবি শাক সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে গত কয়েকদিনে।
“একশ টাকার নিচে তরি-তরকারি কই?” বলছিলেন তিনি।বাড্ডা বাজারে মঙ্গলবার করল্লার পাইকারি দামই কেজিপ্রতি আশি টাকা দেখা গেছে। একজন ক্রেতা জানান চারদিন আগে যেই রসুন ছিল ২২০ টাকা, সেটি এখন ২৪০ টাকা আর ৭০ টাকার লাউ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।কারওয়ানবাজার থেকে পণ্য এনে রমনায় বিক্রি করেন দোকানি লিটন মিয়া। তার দাবি কারওয়ানবাজারের ‘পাইকারি বাজারেই দামে আগুন’ লেগেছে।
টাস্কফোর্স দিয়ে সামাল দেয়া যাবে?
সরকার টাস্কফোর্সের যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করেছে তাতে বলা হয়েছে- টাস্কফোর্স নিয়মিত বিভিন্ন বাজার, বৃহৎ আড়ৎ/গোডাউন/কোল্ড স্টোরেজ ও সাপ্লাই চেইনের অন্যান্য স্থানগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারক করবে।
উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য ন্যূনতম থাকে তা নিশ্চিত করবে ও সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবে তারা।প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত এ টাস্কফোর্স প্রতিদিনের মনিটরিং শেষে একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠাবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন টাস্কফোর্সকে প্রতিটি পণ্যের বিষয়ে আলাদা করে খোঁজ নিয়ে মনিটর করতে হবে।
“তারা কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুদ আছে সেই তথ্য নেবেন। এটা করতে পারলে মজুত করে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা হলেও কমবে,” বলছিলেন তিনি।তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে তিনি প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়ে বলেন এই কমিশনের কাছেই তথ্য থাকবে যে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুদ আছে। এমনকি কে কোন পণ্য আমদানি করলো, কতটা বিক্রি করলো- এসব তথ্যও তাদের কাছে থাকবে।
ফলে কেউ যেমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারবে না, আবার বাজার সম্পর্কেও একটি পূর্ণ তথ্য সম্বলিত ধারণা সরকারের হাতে থাকবে।এগুলো না হলে দীর্ঘমেয়াদে টাস্কফোর্স নিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া বলছেন টাস্কফোর্স ঠিক মতো মনিটর করতে পারলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে বলেই আশা করছেন তিনি।
দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার, যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তথ্যসূত্র: কালের কন্ঠ,যুগান্তর,বিবিসি বাংলা