জাতিসংঘ মহাসচিবের পদত্যাগ চাইল ইসরাইল
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নির্বিচার বিমান হামলার নজিরবিহীন সমালোচনা করায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের পদত্যাগ দাবি করেছে তেল আবিব। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলার্ড ইর্ডান বলেছেন, গুতেরেসের এ বক্তব্য ‘জঘন্য’ এবং ‘ভয়ানক’। এটির সঙ্গে আমাদের অঞ্চলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
গুতেরেস গতকাল (মঙ্গলবার) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ইসরাইলে হামাসের হামলা বিনা কারণে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে গাজাবাসীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কারণেই হামাস এ হামলা চালিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, “এটি স্বীকার করে নিতে হবে ইসরাইলে হামাসের হামলা এমনিতেই হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর দখলদারিত্বের শিকার হয়েছে। তারা তাদের ভূখণ্ড [ইহুদি] বসতিতে পরিণত হতে এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছে। তাদের অর্থনীতির গলা টিপে রাখা হয়েছে। এই মানুষগুলো বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।”
স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘ মহাসচিবের চরম সত্য কথাগুলো মেনে নিতে পারেনি তেল আবিব। গুতেরেসের এ বক্তব্যের পরপরই তার পদত্যাগ দাবি করেন জাতিসংঘের ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলার্ড ইর্ডান। সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে তিনি বলেন, “যারা ইসরাইলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ‘সবচেয়ে ভয়ংকর’ কর্মকাণ্ডের পেছনে যুক্তি দেখাতে চান, তাদের সঙ্গে কথা বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমি অনতিবিলম্বে তার (গুতেরেসের) পদত্যাগ দাবি করছি।”
ইসরাইলি দূত আরও বলেন, গুতেরেসের এ মন্তব্য ‘সন্ত্রাসবাদ’ এবং ‘হত্যাকে’ বৈধতা দেয়ার সামিল। এটি খুবই দুঃখজনক তার মতো ব্যক্তি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান যেটি সৃষ্টি হয়েছিল ইহুদিদের উপর (কথিত) ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের (হোলোকাস্টের) পর।
উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র সৃষ্টি করার লক্ষ্যে হোলোকাস্ট নামক যে কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়েছে নিরপেক্ষ ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা তাকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সংখ্যক ইহুদিকে হত্যার কথা বলা হয় তা যেমন কাল্পনিক তেমনি তাদেরকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করার দাবিও ডাহা মিথ্যা।
তেল আবিবে বড় বিক্ষোভ
নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ওপর ইহুদিবাদী ইসরাইলের বর্বর আগ্রাসনের প্রতিবাদে ও যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে তেল আবিবে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, গতকাল (রোববার) শত শত মানুষ তেল আবিবের যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করে। এসব বিক্ষোভে অংশ নেয়া লোকজন হামাসের হাতে বন্দী থাকা ইহুদিদেরকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানায়।
একইসাথে তারা যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করে। চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল- ইসরাইলের ভেতরে নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবি উঠবে।
গত ৭ অক্টোবর হামাস ও জিহাদ আন্দোলনসহ কয়েকটি প্রতিরোধকামী সংগঠন ইসরাইলের ভেতরে ইতিহাসের সেরা ও সফল অভিযান চালায়। সে সময় প্রতিরোধ যোদ্ধারা আড়াইশ ব্যক্তিকে বন্দী করে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু বিদেশী নাগরিকও রয়েছে। অবশ্য, এরইমধ্যে কয়েকজনকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গাজায় স্থল অভিযান চালাবে নেতানিয়াহু!
বন্দীদের জীবনের বিনিময়ে হলেও
নেতানিয়াহুর মন্ত্রীসভা গঠনের পর ১০ মাস পেরিয়ে গেছে। এই ১০ মাস ধরে নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করে আসছে। কিন্তু নেতানিয়াহু পদত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদী জনতাকে দমন করার নীতি গ্রহণ করেছে। নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল বিচার বিভাগীয় সংস্কার পরিকল্পনার উদ্যোগ যাতে বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতা কমিয়ে আনা যায় এবং মন্ত্রীসভার বিচারিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু নেতানিয়াহুর বিরোধী দল ও জনগণ মনে করে এই পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। গত ৭ অক্টোবর হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযানের পর নেতানিয়াহু বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর ইসরাইলের হাজার হাজার মানুষ আবারো রাস্তায় নেমে এসে নেতানিয়াহু সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেছে।
তবে এবার নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবির প্রধান কারণ হচ্ছে, হামাস যোদ্ধাদের হাতে আটক ইসরাইলি বন্দীদের অবস্থার প্রতি তার অবজ্ঞা। তাদের অভিযোগ গাজার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ অব্যাহত রেখে নেতানিয়াহু ইসরাইলি বন্দীদের মুক্ত করার কোনো চেষ্টা করছে না। এ ধারণাও করা হচ্ছে, বন্দীমুক্তির বিষয়টি নেতানিয়াহুর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। এমনকি নেতানিয়াহু হামাসের কাছে আটক ইসরাইলি বন্দীদের জীবনের বিনিময়ে হলেও গাজার বিরুদ্ধে স্থল অভিযান চালাবে ।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভের বিষয়টি ছাড়াও জনমত জরিপেও দেখা গেছে তার পদত্যাগের দাবি বেশ জোরালো। ইসরাইলি দৈনিক ‘জেরুজালেম পোস্ট’ জানিয়েছে, একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইসরাইলি নাগরিক অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে ফিলিস্তিনি জনগণ এবং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর নেতানিয়াহুর অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, গাজা যুদ্ধের মধ্যেও ইসরাইলি নাগরিকদের মাত্র ২৮ শতাংশ নেতানিয়াহুকে সমর্থন করে। জেরুজালেম পোস্টের প্রতিবেদনে আরো এসেছে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চারজন ইসরায়েলি মনে করে আল-আকসা ঝড় মোকাবেলায় নেতানিয়াহু এবং তার জোট মন্ত্রীসভার ব্যর্থতার ফুটে উঠেছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জনগণের বিক্ষোভ এবং জনমত জরিপের ফলাফল থেকে বোঝা যায়, গাজায় ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও নেতানিয়াহু তার পতনের রাস্তা তো আটকাতে পারেনি বরং গাজা যুদ্ধে নেতানিয়াহুর মন্ত্রীসভার কর্মকাণ্ড তার পদত্যাগের দাবিকে আরো জোরদার করেছে। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন যে তিনি ফিলিস্তিনিদের সাথে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু এবং নারী ও শিশুহত্যা করে তেলআবিবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন, কিন্তু এখন এই ধারণাটিও উল্টে গেছে। নেতানিয়াহু যদি হামাসের হাতে বন্দী কমপক্ষে ২১০ ইসরাইলিকে মুক্ত করার চেষ্টা না করেন তবে তিনি এবং তার মন্ত্রীসভার নিশ্চিতভাবে পতন ঘটবে।
তথ্যসূত্র: পার্সটুডে