পরশ্রীকাতরতা
আলাপচারিতা
’তোমরা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কার্পণ্য ও সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে দেখতে চান এবং কল্যাণ ও সাফল্য রয়েছে উদারতার মধ্যে। তাঁর বাণী- ‘যে ব্যক্তি স্বীয় মনের সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করলো সে-ই কল্যাণ লাভ করলো’- সূরা তাগাবুন ১৬
বাংলা একাডেমির অভিধানে পরশ্রীকাতর শব্দটির অর্থ দেওয়া আছে এভাবে- অপরের উন্নতি বা সৌভাগ্য দেখে কাতর বা ঈর্ষান্বিত হয় এমন। শব্দটির বিশেষণ পরশ্রীকাতরতা।
পরশ্রীকাতরতা এবং মনের নীচতার সমার্থক হয়ে যায়। যাদের অন্তর বা মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে তারা মানুষের গুণের প্রশংসা করতে পারে না। অন্যদের দেয়া দূরের কথা, কেউ কাউকে দিক সেটাও পছন্দ করে না। মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ এবং একে অপরের প্রতি জুলুম-নির্যাতনের মূলে রয়েছে সংকীর্ণতা। মানুষকে ক্ষমা করার জন্য প্রয়োজন হৃদয়ের প্রশস্ততা। সংকীর্ণ মনের মানুষ ক্ষমা করতে জানে না। সে তার নিজের দোষ দেখে না, শুধু অপরের দোষ খুজে বের করে এবং শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় অন্যান্যদের ছোট ভাবে। সে শুধু নিজের প্রশংসা শুনতে চায়। তার চতুর্দিকে জড়ো হয় চাটুকার।
মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, প্রধানত চারটি কারণেই পরশ্রীকাতরতা জন্ম- ১) না পাওয়ার বেদনা, ২) হেরে যাওয়া আর পরাজয়ের ভয়, ৩) নিজে নিজে করতে না পারা, নিজের অক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে নিজেই নিজের অজান্তে মনের মধ্যে হিংসার আগুনকে উসকে দেয়, ৪) অন্যকে অনুসরণ বা নকল করতে বা টেক্কা দিতে গিয়েই জেলাসির চৌকাঠে পা দিয়ে ফেলে মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ খুব কম বয়সে আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর স্বজাতি বাঙালি বড্ড বেশি পরশ্রীকাতর। তাঁর প্রতিভার মর্যাদা তাঁরা কোনোদিনই দিতে চায়নি। তাঁরা কেবলি তাঁকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করে এসেছে। কিন্তু তাঁর কৃতিত্বের প্রাপ্য সম্মান যখন ভিন্ন জায়গা থেকে অন্যের হাত দিয়ে এলো, কেবল তখনই তাঁদের মনে হলো, তাঁর ওপর এতদিনের অবহেলা করাটা ঠিক হয়নি। এমন মুহূর্তেও রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, এই বোধোদয়টা তাঁদের উত্তেজনা।
প্রসূত, ক্ষণিকের মোহ, জোয়ারের জলের মতো ভাটার টান পড়লে এটা কেটে যাবে। ঠিক এই কারণে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে দেশবাসী যখন তাঁকে সম্মান জানাতে সমবেত হয়, তখন সে সম্মান তিনি আনন্দের সঙ্গে, প্রসন্ন মনে, বিনীতভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। এই সংবর্ধনা অগ্রহণের কারণ কী? এক ঈর্ষাপরায়ণ জাতিকে তিনি কী কোনো শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন? এক গভীর অর্থে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টি তো আমাদের শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট। কিন্তু সেই শিক্ষা কি তাঁর জাতি ভালোভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিল? একেবারে মৃত্যুর আগ-মুহূর্তেও রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, তাঁর জাতি মনের দিক থেকে অপরিবর্তিত থেকে গেছে!
নোবেল পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়েছিল ১৯১৩ সনের ১৩ নভেম্বর। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানাবার জন্য ২৩ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে দেশের সর্বপ্রধান মান্য ও বিদ্বান লোকেরা সমবেত হয়েছিলেন। সংবর্ধনার নানা তর্পণ শেষ হলে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে বলেছিলেন, ‘আজ আমাকে সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে-সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসংকোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।’ কারণটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেন, কবিবিশেষের কাব্যে কেউ বা আনন্দ পান, কেউ বা উদাসীন থাকেন, কারো বা তাতে আঘাত লাগে এবং তাঁরা আঘাত দেন। আমার কাব্য সম্বন্ধেও এই স্বভাবের নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি, একথা আমার এবং আপনাদের জানা আছে। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতকাল আমি তা নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কি জন্য যে বিদেশ হ’তে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখন পর্যন্ত আমি নিজেই ভাল করে উপলব্ধি করতে পারিনি।
দেশের লোকের কাছ থেকে এতদিন রবীন্দ্রনাথ কেবলি ‘অপযশ ও অপমান’ লাভ করে এসেছিলেন। আজ যখন পাশ্চাত্য থেকে প্রতিভার যথার্থ সম্মান এসেছে, তখন দেশের লোকের কাছ থেকে এমন সমবেত পাঁচজন লোকের কাছ থেকে সংবর্ধনা নেবার মূল্য কী? তাই রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, ‘যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল-প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রস বৃদ্ধি করতে পারে না।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন, তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? আমার আজকের এই দিন তো চিরকাল থাকবে না। আবার ভাটার বেলা আসবে, তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।
ঠিক এই কারণে তিনি দেশবাসীর সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্ছি- যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু সাময়িক উত্তেজনার মায়া যা, তা স্বীকার করে নিতে আমি অক্ষম। কোনো কোনো দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন, তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমি চিত্তকে দূরে রাখতে চাই।
দেশের লোকের কাছ থেকে শুধু ‘অপযশ ও অপমান’ পাওয়া থেকেই কী রবীন্দ্রনাথ উক্ত সংবর্ধনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? অনেক রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, দেশবাসীর উল্লিখিত সংবর্ধনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রীতি অপেক্ষা জাতীয় আত্মাভিমানের তৃপ্তি বেশি ছিল। কবি হিসেবে দেশবাসীর কাছে রবীন্দ্রনাথের একটা একান্ত চাওয়া ছিল। ১৯১৪ সনের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে রামমোহন লাইব্রেরিতে দেওয়া বক্তৃতায় সেই চাওয়ার কথাই অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ভাষায় ব্যক্ত করেন। সেখানে তিনি বলেন, কবি যখন আপনার হৃদয়ের আনন্দে গান গেয়ে ওঠেন তখন তার সবচেয়ে বড় দুঃখ হয় যদি সে তার দেশের, তার ঘরের ভায়েদের সহানুভূতি না পায় এবং তার সবচেয়ে বড় সুখ, সবচেয়ে বড় পুরস্কার সে পায় তাদের স্বতঃউচ্ছ্বসিত প্রীতিতে। একথা বললে মিথ্যে বলা হবে যে, কবে কোনো সুদূর ভবিষ্যতে তার আদর হবে এই আশায় কবি নিশ্চিন্ত থাকে না, এরকম উপবাস করে থাকা যায় না। কবি চায় সমস্ত প্রাণ দিয়ে সহানুভূতি, প্রীতি- তার অভাবে তার কি বিপুল বেদনা তা সে ছাড়া আর কেউ বুঝে না। আমি জগতের হাত থেকে সম্মান নিতে পারি, কিন্তু আমার মার হাত থেকে, আমার ভায়ের হাত থেকে প্রাণের প্রীতি ছাড়া কিছু গ্রহণ করতে পারি না। ওই প্রীতি আমি প্রাণভরে চাই-আপনারা আমাকে তাই দিন।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর দেশবাসীর মনোভাব বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি। সংবর্ধনা প্রত্যাখ্যানের ফল ভালো হয়নি। তাঁর প্রতি দেশবাসী আরও বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়ে। আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের ‘নোবেল পুরস্কার- বর না শাপ’ অধ্যায়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ দেশবাসীর সমাদর যেভাবে প্রত্যাখ্যান করিলেন তাহাতে বাঙালির মধ্যে তাঁহার প্রতি পুরাতন যে বিদ্বেষ ছিল তাহা আরও উগ্র হইয়া উঠিল। বলিতে গেলে পরদিন হইতেই আবার আক্রমণ ও অপমান আরম্ভ হইল। শত্রুরা একথা পর্যন্ত বলিল যে, ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি আসলে ইংরেজ পীয়ারসনের, তাঁহার নিজের নয়।’ ইংরেজি জানতেন না, এ অপবাদ রবীন্দ্রনাথকে অনেক আগে থেকে হজম করতে হয়েছিল। অগ্রহায়ণ ১৩৩৬ সনে লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সে-কথা গভীর বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন।
একজন মুসলমান তার হন্তাকেও ক্ষমা করতে পারে
আল্লাহপাক সূরা ইয়াসিনে (১৩-৩০) বর্ণনা করেছেন, একটি জনপদে তিনজন রসুল পাঠানো হয়েছিল। তাঁদের চেষ্টায় একজন ব্যক্তি মুসলমান হলে সেই আল্লাহর বান্দা তাঁর জাতির কাছে এসে দাওয়াত দিলে তারা তাঁকে হত্যা করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়, দাখিল হও জান্নাতে। সে সময়ে তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, ‘হায়! আমার জাতির লোকেরা যদি বুঝতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন’। কোনো অভিশাপ নয়, বদ দোয়া নয় বরং মৃত্যুর সময়ও এই শরিফ ব্যক্তিটি তাঁর হন্তাদের কল্যাণ কামনা করেছেন। একজন ঈমানদার ব্যক্তির হত্যার বদৌলতে আল্লাহপাক সেই জাতিকে ধ্বংস করে দেন।