বিএনপির নেতৃত্বের উপর দলটির অনেকেই নানা কারণে ক্ষুব্ধ
এ খবরের পরেই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেবার জন্য মনস্থির করেন বি চৌধুরী
সম্প্রতি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সাবেক দুইজন নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার। দুই হাজার পনের সালে গঠিত তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯শে সেপ্টেম্বর, আর তাতেই যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারপারসন এবং মহাসচিব হয়েছেন মি. চৌধুরী এবং মি. আলম।
বিএনপি বলছে, সাবেকদের নতুন দল গঠন বা ভিন্ন দলে যোগদান নিয়ে দলটি মোটেও চিন্তিত নয়।
দলটির নেতারা দাবি করেছেন, এ ধরণের ঘটনা বিএনপির কোন ক্ষতি আগেও করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও করতে পারবে না।
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ছেড়ে অন্য দল গঠনের এমন ঘটনা দেশের অন্যতম প্রধান এই দলটির জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
বিএনপি থেকে বেরিয়ে সাবেক নেতাদের ভিন্ন দলে যেগাদানের ঘটনা এটাই প্রথম নয়।
বিভিন্ন সময় বিএনপি থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সাবেক নেতারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন – দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে সেসব দলের অধিকাংশেরই হয় নামে বা প্রতীকে কোন না কোনভাবে বিএনপির ছায়া দেখা যায়।
কোন দলের নামের সাথে বিএনপির ছায়া রয়েছে, কেউ দলীয় প্রতীক হিসেবে ধানের শীষ সদৃশ কিছু বেছে নিয়েছেন, আবার কেউ নিজের দল নিয়ে পরে ফিরেছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটেও।
কেন তৃণমূল বিএনপিতে?
তৃনমূল বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর শমসের মবিন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ২০১৫ সালে বিএনপি ছাড়ার সময় তিনি তার পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন যে, ভবিষ্যতে শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে এবং সুযোগ পেলে জনগণের সেবা করবেন তিনি।
সেই লক্ষ্য থেকেই তিনি রাজনীতিতে অবদান রাখতে চান বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন মি. চৌধুরী।
সাবেক কূটনীতিক, সেনা কর্মকর্তা এবং বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান মি. চৌধুরী ২০১৫ সালে যখন রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দেন, তখন অনেকে অবাক হয়েছিলেন।
সেসময় অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কোন কারণ দেখাননি তিনি।
তবে তার তিন বছর পর ২০১৮ সালে মি. চৌধুরী বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দেন।
তখন বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রশ্নে’ মতবিরোধের কারণে বিএনপি থেকে অবসরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেয়ার কারণ হিসেবে মি. চৌধুরী বলেন, এই দলের নীতি, আদর্শসহ অনেক কিছু রয়েছে যা তার পছন্দ হয়েছে। এছাড়া তার চিন্তাধারা নিয়েও দলটি তার সাথে একমত হয়েছেন।
বিএনপির বিষয়ে মি. চৌধুরী বলেন, “যে কারণে বিএনপি ছেড়ে এসেছিলাম সেই কারণ তো এখনো রয়েছে। ফিরে যাওয়ার জন্য তো ছেড়ে আসিনি। ছেড়ে আসছি ওখান থেকে চিরতরে।”
অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তৈমুর আলম খন্দকার।
গত দুই বছর ধরে বিএনপি দেশের কোন নির্বাচনে অংশ না নিলেও, ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন তৈমুর আলম খন্দকার।
দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কারণে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে।
বিএনপি ছেড়ে যারা দল গঠন করেছেন
বিএনপির বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে দলটি ত্যাগ করে গিয়ে নতুন দল গঠন করেছেন। তালিকায় শুরুতেই বলা যায় বিকল্প ধারার কথা।
বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। পরে ২০০২ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পরে তিনি বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেন।
তার পদত্যাগের আগে অবশ্য সংসদে তার অভিশংসন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে সর্বসম্মতিক্রমে আহ্বানও জানানো হয়েছিল।
তার বিরুদ্ধে সেসময় বিএনপি যেসব অভিযোগ এনেছিল তার মধ্যে রয়েছে – বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া, এবং জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
দুই হাজার দুই সালে পদত্যাগের পর মি. চৌধুরী ২০০৪ সালের মার্চে বিকল্প ধারা বাংলাদেশ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
তিনি এখনো দলটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন। এই দলটির মহাসচিবের পদ রয়েছেন আরেক সাবেক বিএনপি নেতা এম এ মান্নান। সেবছর মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে জয়লাভ করেছিল দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন,বদরুদ্দোজা চৌধুরী জানতেন যে তার নিজের কোন শক্তি নাই। বিএনপির শক্তিতে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
“গো ধরে বসে থাকার মতো মনের জোর তার ছিল না। তিনি পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ করার পর তিনি নানা ভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। পরে তিনি বিকল্প ধারা তৈরি করেন,” বলেন মি. আহমেদ।
এরপর ২০০৬ সালের ২৬শে অক্টোবর কর্নেল অলি আহমেদ বিএনপি থেকে বেরিয়ে লিবেরাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি নামে নতুন দল ঘোষণা করেন।
কর্নেল অলি আহমেদ ছাড়াও বিএনপির ১১ জন সংসদ সদস্য ওই নতুন দলে যোগ দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির তালুকদার, জাহানারা বেগম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরসহ বেশ কয়েকজন নেতা।
কয়েক বছর পরে ২০১২ সালের জুনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন দলটির আরেক শীর্ষ নেতা নাজমুল হুদা।
পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময় তথ্যমন্ত্রী এবং পরে ২০০১ সালে গঠিত সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। যাদের হাতে বিএনপি দলটি গড়ে উঠেছিল মি. হুদা ছিলেন তাদের একজন। আবার এই দল থেকে তিনি বহিষ্কৃতও হয়েছেন।
পরে দলে ফিরলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানাতে তাঁর দাবি পূরণ করেননি, এই অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের জুন মাসে তিনি পদত্যাগ করেন।
মি. হুদা বিএনপি ছাড়ার পর ২০১২ সালের ১০ই অগাস্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট-বিএনএফ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
পরের বছর ২০১৩ সালে দলটি নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায়। তবে কয়েক মাস পর দলটির প্রধান সমন্বয়ক এস এম আবুল কালাম আজাদ মি. হুদাকে বহিষ্কার করেন।
এরপর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স-বিএনএ এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি নামে আরো দুটি দল গঠন করেছিলেন তিনি।
সবশেষ ২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি দল গঠন মি. হুদা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি।
তবে চলতি বছরের ১৯শে ফেব্রুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নাজমুল হুদা।
তার মৃত্যুর পর তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মি. হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা।
ভিন্ন ভিন্ন দলের কারণে কি ক্ষতি হবে বিএনপির?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনের খুব বেশি একটা সময় বাকি নেই। নির্বাচনে আগে অনেক ধরণের রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয় দেশে।
এ অবস্থায় অনেকেই বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইতে পারেন উল্লেখ করে মি. আহমেদ বলেন, বিএনপির নেতৃত্বের উপর দলটির অনেকেই নানা কারণে ক্ষুব্ধ।
মি. আহমেদ বলেন, বিএনপি ছেড়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সেটা চলতে থাকলে বিএনপির জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
তবে বিএনপি যদি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়, শুধুমাত্র তাহলেই সমস্যা হবে বলে মনে করেন তিনি।
“যদি নির্বাচনটা হয়ে যায় কোন ভাবে তাহলে বিএনপি খুবই সমস্যায় পড়বে। আর যদি বিএনপি এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে পারে যে নির্বাচন হবে না, তাহলে যারা এখন দলছুট হচ্ছে তারা হারিয়ে যাবে।”
তবে, পুরো বিষয়টিই বিএনপির শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মি. আহমেদ বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে সেটা বৈধতা পেয়ে যাবে।
“কারণ বিএনপি ছাড়া যদি অন্য সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়, এবং বিএনপির নেতারাও যদি অন্য সব রাজনৈতিক দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে, নির্বাচনের পর বিএনপি একাকী হয়ে পড়বে,” ব্যাখ্যা করছেন তিনি।
বিএনপি যা বলছে
সাবেক নেতাদের ভিন্ন দল গঠনের ফলে বিএনপির ক্ষতি হবে এমন কথা মানতে নারাজ দলটির শীর্ষ নেতারা।
তারা বলছেন, বিএনপি থেকে দুই-এক জন নেতা বেরিয়ে গেলেও তাতে ক্ষতির কোন কারণ দেখছেন না তারা।
সোমবার বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকারের তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেয়া নিয়ে সাংবাদিকদেরা প্রশ্ন করলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “তারা কেউই বর্তমানে দলের সদস্য নন। সে কারণে তারা আলাদা দল গঠন করলে বিএনপির কোন আপত্তি নেই।”
তিনি বলেন, “বিএনপি একটা বিশাল প্রবাহমান নদীর মতো। এখানে কত খড়কুটা আসে, কত খড়কুটা যায়। কাজেই বিএনপির কিছু যায় আসে না। কেউ আলাদা দল গঠন করলে এতে দলের আপত্তি নেই।”
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, যারা চলে গেছে তাদের যাওয়ার ফলে বিএনপি দুর্বল হয়েছে বলে দল মনে করে না।
এছাড়া যারা গেছেন তাদের মধ্যে একজন বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং আরেক জনকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, উল্লেখ করে মি. খান বলেন, তাদের কেউই এখন আর বিএনপির নেতা নয়।
“কাজেই এতে বিএনপির ক্ষতি হওয়ার কী আছে তা তো বুঝি না আমি।”
চলতি বছর তৃণমূল বিএনপির নিবন্ধন দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা অভিযোগ করে বলেন, “সরকারের হাত রয়েছে এই দলের নিবন্ধন দেয়ার পেছনে। এই দলটির নিবন্ধন পাওয়ার শর্ত পূরণ করার কোন সুযোগ নাই।”
তিনি আরো বলেন, “সরকার এর আগের ইলেকশনের আগেও এমন রেজিস্ট্রেশন দিয়েছিল। কী হয়েছে তাতে? বিএনপির কোন ক্ষতি হয় নাই।”
নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি একটা বিশাল রাজনৈতিক দল। এর আগে অনেক বার অনেক লোক দল ছেড়ে গেছে।
শুধু বিএনপি নয় বরং আওয়ামী লীগ ছেড়েও দলটির অনেক নেতা এর আগে চলে গেছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “বড় রাজনৈতিক দলে এগুলো হয়। কিন্তু তাতে খুব একটা দল যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা না। অনেক সময় কারো কারো অনেক আগ্রহ বা ইচ্ছা থাকে যেটা পূরণ করা হয়তো দলের পক্ষে সম্ভব হয় না।”
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা