মেহেরপুরের মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি
বলরাম হাঁড়ির আখড়া মেহেরপুর শহরের মালোপাড়ার ভৈরব নদীর তীরে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত নব বৈষ্ণব ধর্মের লোকিক উপশাখা বা গৌণ লোক ধর্ম বলরামি সম্প্রদায়ের কেন্দ্র ভূমি ছিল বলে ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে অথবা ১৯ শতকে প্রবর্তিত এই লোক ধর্মে এক সময় বিপুল সংখ্যক নিম্ন বর্ণের হিন্দু মানুষ আকৃষ্ট হয়ে দীক্ষিত হয়েছিল। বলাহারীরকাল আনুমানিক ১৭৮০ থেকে ১৮৫০ সাল হারিস শব্দটি বলরামিদের মতে কোন বর্ণ নয় বলরাম হাড়ের সৃষ্টি করেছেন এই কারণে হাড়ি ভক্তের কাছে তিনি ঈশ্বর বলরামি তত্ত্ব তাদের গানে প্রকাশিত বলরামিরা মনে করে থাকে যে বলরাম পূর্ণ ব্রাহ্মসনাতন।
বলরাম হাড়ি মেহেরপুরের মালোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি প্রথম জীবনে স্থানীয় জমিদার পদ্মলোচন মল্লিক এর বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে কাজ করতেন। তাদের বিশদেবতা আনন্দ বিহারী দেবের অলংকার চুরি হয়ে গেলে তাকে সন্দেহ করে কঠোরভাবে শাসন করা হয়। এই অপমানে বিচিত হয়ে তিনি সংসার ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী যোগ সাধনায় লিপ্ত হন। ইতিহসে দেখা য়ায় এ নিম্নবর্গের শূদ্র পুরুষ তুমুল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শাসনশোষনের বিরুদ্ধে। সময়টা ছিল উনিশ শতক।
মেহেরপুরের জমিদার জীবনী প্রদত্ত বলরামের নামে ৩৫ শতক জমি দান করা হয়েছে এখানে বড় নামের সমাধি মন্দির রয়েছে। বারণী তিথিতে প্রতিবছর এখানে মেলা বসে থাকে এই মেলা বলরামের উৎসব হয়।বাংলা ১২৫৭ সালের ৩১ শে অগ্রহায়ণ। বলরাম মৃত্যুবরণ করেন।
বলরামের মন্দির
মেহেরপুরের মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি এবং তাঁর জীবনদর্শন সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন যেয়েও আছে থেকেও নাই/তেমনই তুমি আর আমি রে ।
মেহেরপুর জেলা ছিল তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলায়। মেহেরপুর জেলার বুক চিরে বইছে ভৈরব নদী। জেলা সদরটি ছোট। পশ্চিমদিকের মালোপাড়া। সেখানে কয়েক ঘর অন্ত্যজ শ্রেণির বাস। তারা অধিকাংশই জাতে হাড়ি। হাড়িদের পেশা ছিল শুয়োর চরানো, কবিরাজী ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা দারোয়ানী।
১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ মালোপাড়ায় গোবিন্দ হাড়ি এবং গৌরমণির ঘরে জন্মালেন এক শিশু; যে শিশুটি কালক্রমে বাংলার লোকধর্মের অন্যতম পুরোধা হয়ে উঠেছিল। শিশুর নাম রাখা হয় বলরাম হাড়ি। জন্মসূত্রে অন্ত্যজ বলেই আজন্ম ব্রাহ্মণ্য শোষন দেখেছে। তাই তাঁর স্পর্শকাতর মনে জন্ম নিয়েছিল প্রচন্ড ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ। বলরাম হাড়ির ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ সম্বন্ধে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন একদা আশ্বিন মাসে ভৈরব নদীতে ব্রাহ্মণরা পিতৃপুরুষের নাম তর্পন করছিলেন । হঠাৎ তারা দেখেন এক তরুণ বুকজলে দাঁড়িয়ে তর্পন করছে। দেখে অন্ত্যজ বলেই মনে হয়। একজন ব্রাহ্মণ নাক সিটকে বললেন, আরে, এ যে মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি! কী স্পর্ধা! কি রে বলা,
তোরাও কি আজকাল আমাদের মত পিতৃতর্পন করছিস নাকি? বলরাম হাড়ি বললেন, আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করছি। বলিস কি? এখান থেকে জল তোর জমিতে যাচ্ছে কি করে? আকাশ দিয়ে নাকি? আপনাদের তর্পনের জল কি করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে? আকাশ দিয়ে? এই হল বলরাম হাড়ির মেধা, ব্যঙ্গ এবং ব্রাহ্মণবিদ্বেষের নিদর্শন! পেশায় বলরাম হাড়ি ছিলেন মেহেরপুরের ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। একরাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার চুরি হয়ে গেল। সন্দেহ করা হল বলরামকে । তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে প্রচন্ড প্রহার করা হল। তারপর তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এই হল নিম্নবর্গের ওপর অত্যাচারের স্বরূপ। তদন্ত নেই, প্রমানাদি নেই, সন্দেহ হলেই বেধড়ক পিটুনি আর গলাধাক্কা … আমরা গ্রাম থেকে উৎখাত হওয়া বিপন্ন বলরাম হাড়ির মনের করুণ অবস্থা কল্পনা করতে পারি … মালোপাড়ার বলরাম হাড়ির মানবিক চেতনা ছিল উচ্চাঙ্গের। যার ফলে অপমানিত বলরাম হাড়ি পথে পথে ঘুরেও চোরডাকাত কিংবা নৈরাশ্যবাদী হননি, হয়েছেন সাধক … বেশ কয়েক বছর পর বলরাম হাড়ি মালোপাড়ায় ফিরে এলেন। আগের সেই মানুষটি অনেক বদলে গেছেন। পরনে সিদ্ধাই সাধুর বেশ। ভৈরব নদীর ধারে নির্মান করলেন সাধনকুটির।
বলরাম হাড়ির সাধন সঙ্গিনী হলেন ব্রহ্ম মালোনী নামে এক নারী। ইতিমধ্যে অলংকার চোর ধরা পড়েছিল বলে অনুতপ্ত মল্লিক পরিবার বলরামকে অর্থ আর জমি দিলেন। মালোপাড়ায় নির্মান করলেন হাড়িরামের মন্দির। কে এই হাড়িরাম? সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে বলি যে, দলে দলে কৈবর্ত, বেদে, বাগদি এবং নমঃশূদ্ররা এসে বলরাম হাড়ির কাছে আশ্রয় নিলেন। এরা সবাই ব্রাহ্মণদের দ্বারা শোষিত বলরাম হাড়ি এখন তাদের মুর্শিদ। তৈরি হল এক নতুন ধর্মমত আর বিশ্বাস। যে বিশ্বাসকে বলা হল: ‘বলা হাড়ির মত’। হাজার বিশেক ভক্তশিষ্য জমে গেল বলরাম হাড়ির। এদের বলা হল: বলরামী।বলরামী সম্প্রদায়ের কোনও বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন বা বেশবাস ছিল না। এদের অনেকেই ছিলেন ভিক্ষাজীবী। ঠাকুর দেবতার নাম তারা কখনও উচ্চারণ করত না। বাংলার অন্যান্য লোকধর্মের অনুসারীরা অবতারতত্ত্ব মানলেও বলরামীরা মানতেন না। এঁদের সবচে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ব্রাহ্মণবিদ্বেষ। তার কারণ আছে।
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় শূদ্রশ্রেণির নানা দিক থেকে অসহায় হয়ে পড়েছিল। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ছিল না। এ র ওপর মড়ার উপর খরার ঘায়ের মতো উচ্চবর্ণের দমনপীড়ন তো ছিলই । বলরাম হাড়ি অন্ত্যজ-শূদ্রদের বাঁচার জন্য একটা জায়গা তৈরি করেছিলেন। সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা। মূর্তিপূজা,অপদেবতা পূজা, অকারণ তীর্থভ্রমন,দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্র নির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে এঁর অস্ত্র ছিল জাতিভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মবিশ্বাস।
সূত্র: মেহেরপুর ইতহিস সূধীর চক্রবর্তী; গভীর নির্জন পথে।