যখন শাসক ভালো হয়, তার প্রজারাও ভালো হয়, আর যখন শাসক খারাপ হয়, তার প্রজারাও খারাপ হয়
রুহুল কুদ্দুস টিটো
প্রাণের ও মনের সমন্বিত উপলব্ধির জন্যই মানুষ সৃষ্টির সেরা। আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে এবং বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে হলে আত্মশুদ্ধি অবশ্যই জরুরি। দেহের জন্য যেমন খাদ্য দরকার, তেমনি অন্তর বা আত্মাকে বাঁচাতেও লাগে বিশেষ খাদ্য। অন্তরের সেই ‘খাদ্য’ই আল্লাহ পাকের ইবাদত। পরিপূর্ণ সুস্থতার সাথে দুনিয়ায় টিকে থাকতে মানুষের জন্য এই দুই প্রকার খাদ্যই নিয়মিত দরকার। দেহের খাবারের সাথে দরকার আত্মার জন্যে নিয়মিত ইবাদত।
মানুষকে সহজেই নানান কৌশলে ধোঁকা দেয়া যায় বা বোকা বানানো যায়, কিন্তু মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলআমিনকে কি কোনোভাবেই ধোঁকা দেয়া সম্ভব না, কারণ তিনি সেই মহান সত্ত্বা যিনি মানুষের প্রকাশ্য-গোপন ও ভেতর-বাহিরের সব কিছু সম্পর্কেই অবগত।
আল্লাহ তাআলা মানুষের অন্তর এবং নিয়ত দেখে থাকেন। আমরা ভাল কাজ যতই করি না কেন হৃদয় যদি স্বচ্ছ না হয় এবং অন্তর যদি পবিত্র না হয় তাহলে এসব ভালো কাজ কোনো কাজেই লাগবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘বলে দিন, তোমরা যদি মনের কথা গোপন করে রাখ অথবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ সে সবই জানতে পারেন। আর আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সেসবও তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভাল কাজ করেছে; চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও দেখতে পাবে। ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দুরের হতো! আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা ইমরান : আয়াত ২৯-৩০)
পুরোপুরি মানুষ হতে হলে থাকতে হয় একটা নিবেদিত অন্তর। অন্তর যেখানে মৃত, সেই দেহ বস্তুত অকেজো। এমন মৃত অন্তর নিয়ে জীবনের সহস্র অর্জনও প্রকৃত অর্থে উপভোগ করা যায় না।
আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অধ্যাত্ম চেতনা, অন্যদিকে মানবজীবনের মূল মর্ম হলো আত্মশুদ্ধি। তাই মানুষের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক সুগভীর।
একজন প্রকৃত স্বাধীন মানুষ নিজের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি অন্যের অধিকার রক্ষায়ও নিবেদিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘আমি কি তাকে তার জন্য দুটি চক্ষু সৃষ্টি করিনি? আর জিহ্বা ও ওষ্ঠ অধরদ্বয়? সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি! তুমি কি জানো, বন্ধুর গিরিপথ কী? এ হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্য দান; এতিম আত্মীয়কে অথবা নিঃস্বকে। অতঃপর সে বিশ্বাসী মোমিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়, যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের ও দয়াদাক্ষিণ্যের। এরাই সৌভাগ্যশালী। আর যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হতভাগ্য। তারা পরিবেষ্টিত হবে অবরুদ্ধ অগ্নি দিয়ে।’ (সুরা ৯০ বালাদ, আয়াত: ৮-২০)।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআন কারিমে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হও; আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা ২ বাকারা, আয়াত: ২০৮)।
অপরিশুদ্ধ আত্মা মানুষকে বিপথগামী করে। আত্মার স্বাধীনতা উন্নত মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। মোহমুক্ত মানুষই সুন্দর মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায়, ‘তাকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সুরা ৭৬ দাহার, আয়াত: ২-৩)।
প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধ ও বুদ্ধির মানুষ জাগতিক জীবনে হয় সফল ও অনুসরণীয়। অস্বচ্ছ ময়লাযুক্ত অন্তর নিয়ে কখনো আল্লাহকে পাওয়া যায় না বা ভালো কিছু করা যায় না।আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও অধ্যাত্ম শক্তি ছাড়া মানবজীবন ব্যর্থ ও বিফল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে।’ (সূরা শোআরা, আয়াত: ৮৮-৮৯)
পৃথিবীতে সকল নবী-রাসুল ও আসমানি কিতাব বা ঐশী ধর্মগ্রন্থের একমাত্র মিশন ছিল মানবাত্মার সংশোধন।আল্লাহর নবীরা সেভাবেই শিখিয়ে গেছেন এবং উৎসাহিত করেছেন মানুষকে আল্লাহ তায়ালার নিরবচ্ছিন্ন ইবাদতের পথে। তাঁরা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, আল্লাহ পাকের নিরাপদ আশ্রয়ই আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ। এ জন্য দরকার নামাজে নিয়মিত যত্নশীল হওয়া; বিপদের সম্ভাবনা মাত্রই নামাজের মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া আর নিশ্চিত করা প্রয়োজন ইবাদতময় পরিবেশ।
মানবাত্মা হলো শাসক, আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার প্রজা। যখন শাসক ভালো হয়, তার প্রজারাও ভালো হয়, আর যখন শাসক খারাপ হয়, তার প্রজারাও খারাপ হয়।
আত্মার সংশোধন শুধু একজন মানুষের জন্যই নয়; বরং ইহকালীন জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি এর ওপরই নির্ভর করে। মানুষের অধ্যাত্ম চেতনা ও আত্মশক্তির অনন্য চালিকাশক্তি হলো ‘কাল্ব’ বা অন্তঃকরণ। এর সুস্থতার সঙ্গে দেহ-মনের সুস্থতা সম্পৃক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘সাবধান! নিশ্চয়ই প্রত্যেক দেহে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে। যখন সেটি ঠিক থাকে, তখন দেহের অন্য অঙ্গগুলোও ঠিক হয়ে যায়। আর যদি তা বিনষ্ট হয়, তাহলে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। এর নাম হলো কাল্ব বা মানবাত্মা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মানুষের আত্মাই দেহের নিয়ন্ত্রক। অন্তর যদি নিজে কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, তবে সারা শরীরের কার্যকলাপও সঠিক থাকবে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে শরীরের সব ব্যবস্থাপনাও বিনষ্ট হবে। তাই সবার আগে আত্মাকে ঠিক করা দরকার। আত্মার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তার স্বচ্ছতা ও মলিনতা। লোহা কিছুদিন মাটিতে পড়ে থাকলে যেমন মরিচা ধরে, নষ্ট হয়ে যায়, তদ্রূপ আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন না হলে বা আত্মাকে সঠিকভাবে পরিচালনা না করা হলে লোহার মতোই মরিচাপ্রাপ্ত হয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে অসৎ চিন্তা এবং কুধারণা বাসা বাঁধতে থাকে। একপর্যায়ে তা আর সঠিকভাবে কাজ করে না। এভাবেই মানুষ তার সৎ কর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘লোহার মতো আত্মাও মরিচাপ্রাপ্ত হয়।’ (তিরমিজি)
‘তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা ৬ আনআম, আয়াত: ১৪২) ‘শয়তান তাদের দুজনকে (আদম ও হাওয়াকে) প্ররোচিত করল; অতঃপর যখন তারা দুজনে ওই বৃক্ষের স্বাদ নিল, তখন তাদের বসন আবরণ খুলে গেল, তারা উভয়ে বাগিচার পাতা দিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করল। তাদের রব তাদের ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদের এই বৃক্ষ বিষয়ে নিষেধ করিনি? আমি কি তোমাদের বলিনি? নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (সুরা ৭ আরাফ, আয়াত: ২২)।
‘হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদের অঙ্গীকার নিইনি যে তোমরা শয়তানের ইবাদত-আনুগত্য করবে না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর শুধু আমারই আনুগত্য ও ইবাদত করো, এটাই সঠিক পথ। সে (ইতিপূর্বে) তোমাদের অনেক দলকে বিপথগামী করেছে, তোমরা কি বুঝবে না?’ (সুরা ৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৬০-৬২)।
ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় বোঝার জন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন। তাই আল্লাহ এই জগতে মানুষকে কোনো কাজে বাধ্য করেন না। এমনকি ধর্মকর্ম বিষয়েও জোর করা হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইসলামে জবরদস্তি নাই, সত্যাসত্য সুস্পষ্ট পার্থক্য হয়ে গেছে। যারা অশুভ অসুরশক্তিকে অস্বীকার করে মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনল; তারা মজবুত হাতল দৃঢ়ভাবে ধারণ করল, যা কখনো ভাঙার নয়; আল্লাহ সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।’ (সুরা ২ বাকারা, আয়াত: ২৫৬)।
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا- وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا- (الشمس 9-10)
‘সফল হয় সেই ব্যক্তি যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে’। ‘এবং ব্যর্থ হয় সেই ব্যক্তি যে তার আত্মাকে কলুষিত করে’ (শাম্স ৯১/৯-১০)।
ইতিপূর্বে বর্ণিত সূর্য, চন্দ্র, দিবস, রাত্রি, আকাশ, পৃথিবী ও মানুষসহ আটটি সৃষ্টবস্ত্তর শপথ করার পর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ উপরোক্ত কথা বলেছেন। এর দ্বারা তিনি অত্যন্ত জোরালোভাবে একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, পবিত্র আত্মার লোকেরাই পৃথিবীতে সফলকাম এবং কলুষিত আত্মার লোকেরা সর্বদা ব্যর্থকাম। তাদের বাহ্যিক পোষাক-পরিচ্ছদ যতই পবিত্র হৌক এবং সামাজিক মর্যাদা যতই উন্নত হৌক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা বা মালের দিকে দেখেন না। বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে’।
উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘তাযকিয়া’ (الةزكية) অর্থ التزكية من الشرك وشوائب المعاصي ‘শিরক ও পাপের কালিমাসমূহ হ’তে পবিত্র হওয়া’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘সফলকাম হ’ল সেই ব্যক্তি যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করল’ (আ‘লা ৮৭/১৪)। মূলতঃ নবী প্রেরণের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে পরিশুদ্ধ করা। যেমন আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ- وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হ’তে একজনকে রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন। আর তিনি তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল’। ‘এবং এটা তাদের জন্যেও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (জুম‘আহ ৬২/২-৩)।
অত্র আয়াতদ্বয়ে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর যুগের ও পরবর্তী যুগে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল আদম সন্তানের আত্মশুদ্ধির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। আর সেই আত্মশুদ্ধির মাধ্যম হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। আর তার ভিত্তিতে যথার্থ ইলম ও আমলের মাধ্যমে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন শুদ্ধিতা অর্জন করা।